ঢাকার ব্যস্ত জীবন থেকে হঠাৎ একদিন চিঠি পেলো অনন্য। হাতে লেখা চিঠি, পাঠিয়েছেন তার দাদু—চট্টগ্রামের রাউজানে থাকেন। চিঠিতে শুধু একটা লাইন—
“এবার আয়, পাহাড়-সমুদ্র-ঝরনার মাঝখানে তোর শিকড় খুঁজে পাবি।”
অনন্যর জীবনে এসবের কোনো দাম ছিল না—সে ছিল ব্যস্ত কর্পোরেট চাকরি, কংক্রিটের শহর আর মোবাইল স্ক্রিনে। কিন্তু কী এক অজানা টানেই হোক, সে ট্রেনে উঠে বসল—চট্টগ্রামের পথে।
স্টেশনেই তাকে নিয়ে গেলো এক অটোচালক, যার মুখে টুকটাক চাটগাঁইয়া ভাষা।
— “কই যাইবেন ভাই? আপনের মুখে শহরের গন্ধ, কিন্তু চোখে পাহাড়ের টান।”
হেসে ফেললো অনন্য। তার মন যেন সত্যিই পাহাড়ে চলে গেছে।
দাদুর বাড়ি রাউজান। উঠেই প্রথমে পেল মেজবানির আয়োজন।
মেজবান! বিশাল ডেকচিতে ফুটছে সাদা গরুর মাংস। পাশে পোলাও, শশা, লেবুর সাজ। স্বাদে এমন মোহ ছিল যে, শহরের দামি রেস্টুরেন্টও যেন হার মেনে যায়।
“এটা শুধু খাওয়া না বাবা,” দাদু বললেন, “এটা মিলন, ঐতিহ্য, অভ্যর্থনার ভাষা।”
পরদিন দাদু তাকে নিয়ে গেল রাঙ্গুনিয়া। পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠতে উঠতে ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে দাদু বললেন, “শোন—এই ঝরনার গান, এই চাটগাঁয়ের প্রাণ।”
চন্দ্রনাথ পাহাড়, পতেঙ্গার ঢেউ, বান্দরবানের সবুজ, আর পাহাড়তলীর ট্রেনলাইন—প্রতিটি জায়গা যেন একটা গল্প বলছিল অনন্যকে। সে হারিয়ে গেলো মানুষের মুখে মুখে থাকা ভাষায়—
“কই গেইলা গা?”
“বুইঝো না হে, চাটগাঁর প্রেম একবার লাগলে আর ছাড়ে না!”
তার চোখে ধরা পড়ল চট্টগ্রামের বর্ণিল সহাবস্থান—বৌদ্ধমন্দির, গির্জা, মসজিদ পাশাপাশি। আদিবাসী মেয়েরা বাঁশি বাজাচ্ছে পাহাড়ের কোলে, আর সমুদ্রের পারে জেলেরা গান গাইছে।
তিন দিন পর ঢাকায় ফেরার দিন, দাদু তাকে আরেকটা চিঠি দিলেন।
চিঠিতে লেখা ছিল—
“চাটগাঁ কেবল একটা জায়গা না। এটা মানুষ, মেজবান, ভাষা, পাহাড় আর সমুদ্রের মিশেল। তুই যদি মন খুলিস, চাটগাঁ তোর হৃদয় ভরে দেবে।”
ট্রেনে বসে অনন্য জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। কর্ণফুলী নদী, ফিশারিঘাট, আর পাহাড়ের সিলুয়েট এক হয়ে যাচ্ছিল।
তার মনে হলো, চট্টগ্রাম তাকে বদলে দিয়েছে। সে শুধু নিজের শিকড় খুঁজে পায়নি, পেয়েছে ভালোবাসা, পেয়েছে একটুকরো বাংলাদেশ—যেটা সে আগে জানতোই না।