✒ রোজিনা খাতুন
সেদিন কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে ছিলো নাম না জানা এক তরুণী।পরনে নীল শাড়ি।মনটা বিষন্ন বার বার এদিক ওদিক মুখ ঘুরিয়ে দেখছে আর ডায়রির পাতায় কিছু লিখছে।মাঝে মধ্যে দাড়িয়ে পায়চারী করছে আবার নিরব মনে শান্ত হয়ে বসছে। দেখে ঠিক বোঝার উপায় নেই কারও জন্য অপেক্ষা করছে নাকি একা সময় কাটাতে এসেছে।
আমি একটুখানি দূরে মোটর সাইকেল রেখে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি।কেনো জানি মেয়েটি নজর কাড়লো। এক কাপের উপরে সেরকম চা খায়না আমি, কিন্তু আজ কেনো জানি পাঁচ কাপ খেয়ে নিলাম। আসলে চা খাওয়া মুখ্য উদ্দেশ্য না দোকানে অযথা বসে থাকা অভদ্রতা দেখাবে এজন্য।
হঠাৎ করেই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও শুরু হলো।দোকান বন্ধ করে দোকানদার বাসায় চলে গেলো।আমি সেখানেই বসে আছি।
নাম না জানা মেয়েটি একইভাবে বসে বসে ডায়েরিতে লিখেই চলছে।একটুও নড়ছে না।আমি বেশ কৌতুহল হয়ে ভাবছি মেয়েটি কি বৃষ্টি পড়ছে এটা বুঝতে পারছে না নাকি ইচ্ছে করে বসে আছে।
আচ্ছা মেয়েটি কি মেঘ আর বৃষ্টির খেলাতে হারিয়ে গেছে প্রকৃতির মাঝে।তাকে অসাধারণ লাগছে এমন সাজে।
আমি এক পা দু’পা করে ভেতরে ভেতর সাহস যুগিয়ে মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখছি বৃষ্টির ফোটা গুলো দু’চোখের পাপড়িতে পড়ছে আর মুখের উপর বিন্দু বিন্দু করে গড়িয়ে পড়ছে আরও মায়াবী লাগছে।আমি একটি বারের জন্যেও নজর সরাতে পারছি না।
মাথা নিচু করে লিখেই যাচ্ছে আমি মানুষটা সামনে দাঁড়িয়ে আছি সেটাও বুঝতে পারছেনা।কি আজব মেয়ে।
আমি বললাম –
শুনছেন বৃষ্টি পড়ছে আপনি তো ভিজে যাচ্ছেন, আপনার ডায়েরির পাতা ভিজে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছেন না?
আপনি পাগল নাকি?
কোনো কথার জবাব নেই।ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি আবারো বললাম -আপনি ভিজে যাচ্ছেন তো।
তবুও কোনো কথা নেই।
আমার একটু রাগ হলো,রাগের সুরে বললাম –
মানুষের কথার জবাব না দেওয়া অভদ্রতা জানেন?
আমি বৃষ্টির মধ্যে কখন থেকে আপনাকে ডাকছি কথা বলছি আপনি আমাকে মানুষ হিসেবে গণ্যই করছেন না।একটা কথার জবাবও দিচ্ছেন না।
সরি আমারি ভুল হয়েছে আপনার সাথে কথা বলা।আমি আসি আপনি যা ইচ্ছে করেন।
এই কথা বলে চলে আসার জন্য সামনে এক পা বাড়িয়ে দিছি,ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন থেকে হাত টেনে ধরলো।আমি ঘুরে দাঁড়ালাম।
হাতের ইশারায় কান আর মুখ দেখালো,যতটুকু বুঝতে পারলাম কানেও শুনে না কথা বলতেও পারে না।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম ।কেমন যেনো নিজেকে অসহায় লাগলো।
এতো সুন্দর একটা মেয়ে কানেও শোনে না কথাও বলতে পারে না?
আমি হাত ইশারায় ডেকে দোকানের সামনে বসালাম।তারপর জানতে চাইলাম নাম কি বাসা কোথায়।ডায়েরিটা আমার হাতে দিলো।প্রথম পৃষ্ঠায় নিজের সুন্দর একটা ছবি আর নাম ঠিকানা লেখা আছে।
নাম তুলসি।বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।এই পাড়াতেই বাসা।প্রতিদিন সময় পেলেই এখানে ঘুরতে আসে আর ডায়েরি লেখে।ডায়েরির পাতায় সহজ সরল জীবনী সব কিছু লেখা আছে।
শুদ্ধ এবং পরিপাটি গোছানো জীবন নখ থেকে শুরু করে চুলগুলো একদম মনে হয় এইমাত্র কেউ একজন সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়ে গেছে।
এবার নিজের পরিচয় দিচ্ছি। আমি শুভ্র।বাবা কলেজের শিক্ষক।বাবা মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে আমি ছোট,আমি সবার আদর আহ্লাদেই মানুষ হয়েছি।
পড়াশোনা শেষ। এজন্য গ্রামে বড় বোনের শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে আসছি।কিছুদিন ঘুরবো ফিরবো আবার শহরে ফিরে যাবো।
বৃষ্টি খুব জোরে শুরু হলো সাথে ঝড়ো হাওয়া।তুলসি হঠাৎ বৃষ্টির মধ্যে ভিজে নাচতে শুরু করলো মনের আনন্দে।আমি শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
তুলসি নাচতে নাচতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।আমি দৌড়ে কাছে গেলাম।শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে তুলসির নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।দেখে মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে।
আমি কি করবো মাথায় আসছে না।আমার শার্ট খুলে মাথা মুছে দিলাম। হাতের তালু ঘসে গরম করার চেষ্টা করছি কিছুতেই তুলসিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে পারছি না।
অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে চলেছে।
এদিকে বৃষ্টি একটুও কমছে না।তুলসির কাছে ডায়েরি আর কলম ছাড়া একটা ফোন নেই, যেটা দিয়ে ওর বাড়িতে কল দিবো।বাড়ি চিনি না কিভাবে পৌছে দিবো।পড়লাম তো মারাত্মক সমস্যার মধ্যে।
মনে মনে ভাবলাম আগে বাজারে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় সুস্থ হলে তারপর যা হবার হবে। মোটর সাইকেলের পিছনে বসিয়ে শার্ট দিয়ে আমার সাথে গিট বেঁধে ভিজতে ভিজতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম।
ডাক্তার তুলসি কে দেখেই চিনে গেলো।তুলসির শারীরিক অসুস্থতার বিষয় আমার কিছু বলা লাগলো না উনি নিজেই ইনজেকশন আর গ্যাস দিতে লাগলো।
অল্প সময়ের মধ্যে তুলসি পুরোপুরি না হলেও মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেলো।
তারপর ডাক্তার ইশারা ইঙ্গিতে বললেন -মা তুলসি ছেলেটা কে?জামাইবাবা?
তুলসি লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো -না।
আমিও অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম এই পরিবেশটাতে।
শুধু বললাম আঙ্কেল আপনি আমাকে চিনবেন না আমি ওর বন্ধু।এখন বলেন তুলসির কি সমস্যা।
ডাক্তার বললেন-তুলসি লক্ষি একটা মেয়ে,জন্ম থেকে কানে শোনেনা-কথা বলতেও পারে না।আর অ্যাজমা শ্বাস কষ্ট রোগটা সাথের বন্ধু। ঠান্ডা একটু এদিক ওদিক হলেই সাক্ষাৎ হয়ে যায় সমস্যার সাথে। আমি ওদের পারিবারিক ডাক্তার।ওর বাড়ি থেকে ফোন দিলেই চলে যায়।চিন্তার কারণ নেই ওর বাড়িতে ফোন করেছি তারা নিয়ে যাবে।
আমি মনে মনে ভাবছি তুলসির বাড়ির লোকজন নিতে আসার আগে আমি চলে যাবো এখান থেকে।কিন্তু কিছুতেই মন চায় না তুলসিকে ছাড়তে।অদৃশ্য মায়ার জালে বন্দি হয়ে গেছি।বুকের মধ্যে কেমন তোলপাড় করছে কিভাবে ছেড়ে থাকবো।
তুলসি কি একবারো বুঝতে পারছেনা শুভ্র তাকে ভালবেসে ফেলেছে। সারাজীবনের জন্য পাশে থাকতে চাই।
ভাবতে ভাবতে মন কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো,এর মধ্যে তুলসিকে বাড়িতে নিয়ে গেলো তার বাবা।যাওয়ার সময় পিছনে বার বার তাকাচ্ছে তুলসি ওর চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারছি আমাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে আর কখনও দেখা হবে কি না এটাও ভাবছে।
একঝলকে চোখের আড়ালে চলে গেলো।যোগাযোগের কোনো মাধ্যম নেই যার সূত্র ধরে আবার দেখা হবে।
শুভ্র মন খারাপ করে বোনের বাসায় ফিরে আসলো।
আর এদিকে তুলসি বাড়ি গিয়ে ভেজা কাপড় চেন্জ না করেই দরজা লাগিয়ে ডায়েরির পাতা উল্টাতে লাগলো ওর চোখ জোড়া দেখে মনে হয় খুঁজছে হারিয়ে যাওয়া মূল্যবান কিছু।
অবশেষে ডায়েরির শেষ পাতায় একটা লেখা পড়া শুরু করলো যেটা নিজের লেখা না।
প্রাণের প্রিয়া তুলসি,
পত্রের শুরুতেই জানাই আমার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার শুভেচ্ছা।আজ হঠাৎ করেই নীলপ্রজাপতির বেশে তুমি এসেছো আমার মনের আঙিনায়। আমার আশা নয় বিশ্বাস তুমি বুঝতে পেরেছো আমি তোমাকে প্রথম দেখাতেই ভালবেসে ফেলেছি।তোমার শারিরীক যতো সমস্যায় থাকুক তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই বরং এই কারণ গুলোর জন্যই তোমার প্রতি আমি বেশি দূর্বল হয়ে পড়েছি এবং ভালবাসছি।আমি তোমাকেই বউ হিসেবে চায়।বিশ্বাস করো তুলসি,তোমাকে কোনোদিন অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না, খুব সুখে রাখবো।জানো তুলসি তুমি যখন বৃষ্টিতে ভিজে পাগলামী করছিলে তখন যেনো হারিয়ে গিয়েছিলাম তোমার হাত ধরে মেঘেদের দেশে।যায় হোক তুলসি তোমার অনুমতি ছাড়া ডায়েরিতে লেখার জন্য সরি।কি করবো বলো সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো আমি তোমার সাথে ভালো করে কথাও বলতে পারলাম না।
পরিশেষে তোমার সুস্থতা কামনা করছি।আর আগামীকাল বিকালে তোমার প্রিয় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে অপেক্ষা করবো।
যদি একবিন্দুও ভালবেসে থেকো তাহলে একটিবার এসো।
তোমার ভালবাসার পাগল
শুভ্র
চিঠিটা পড়ে তুলসির চোখে পানি এসে গেলো।ভাবতে লাগলো-আমাকেও কেউ ভালবাসতে পারে? আমিও কারো ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য?বাড়ির লোক পাড়ার লোক কত অবহেলা অপয়া বলে।আর এই অচেনা অজানা ছেলেটা আমাকে এতো ভালবাসে?আমি অসুস্থ হয়ে গেলে কত যত্ন করলো দায়িত্ব নিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো।
আমি এখন কি করবো শুভ্রর ডাকে সাড়া দিবো?
নাকি প্রত্যাখান করবো।আমার জন্য তার সুন্দর জীবন নষ্ট হয়ে যাবে তাছাড়া তার বাবা মা কেনো মানবে আমাকে।
হাজারো প্রশ্ন মাথায় ভিড় জমতে থাকে।
আগামীকাল বিকালে শুভ্রর সাথে দেখা করে বুঝিয়ে বলবো সে যেনো পাগলামি না করে।
রাত কেটে গেলো।পরদিন বিকালে তুলসি আর শুভ্র দেখা হলো।
কেউ কোনো কথা বলছে না।নিরব হয়ে বসে আছে দুজন।শুভ্র কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।
হঠাৎ তুলসি ডায়েরি দিলো শুভ্রর হাতে।
শ্রভ্র,
প্রথমেই বলছি চিঠি কিভাবে লিখতে হয় আমি জানি না।আমি সাজিয়ে গুছিয়ে লিখতেও পারিনা এজন্য সরাসরি বলছি।আপনি অবশ্যই জানেন আমি কানে শুনি না কথা বলতেও পারি না আর যে রোগ আমার শরীরে আপনার সংসারের কাজ কর্মও ঠিক ভাবে করতে পারবো না।আমি শুধু নামে একটা নারী।জানেন আমার একটা গোপন রোগ আছে যেটা কেউ জানে না,শুধু আমার পরিবারের লোকজন ছাড়া।জানেন শুভ্র আমি কোনদিন মা হতে পারবো না।আর
আমার এতো গুলো সমস্যা নিয়ে আমি আপনার জীবনটা নষ্ট করতে চাই না।যদি সম্ভব হয় আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।আপনি খুব ভালো মানুষ। এমন মানুষ কে ঠকানো পাপ হবে।
অভাগী তুলসি
তুলসি ডায়েরিটা শুভ্রর দিকে এগিয়ে দিলো।শুভ্র মনোযোগ দিয়ে পড়লো।কিন্তু হাজারো সমস্যা জানার পরেও সিদ্ধান্তে অটুট রইলো।
তুলসিকে ইশারা ইঙ্গিতে বোঝালো তোমার সন্তান না হলেও সমস্যা নেই আমি আফসোস করবো না কোনদিন।মনে করবো বিধাতার বিধানে লেখা নেই আমরা বাবা মা হবো।আর তিনি চাইলে নিশ্চয়ই মিরাক্কেলও ঘটে। কিন্তু তোমাকে হারানোর বেদনা আমি সয়তে পারবো না।
আমি যে কোনো কিছুর বিনিময়ে তোমাকে চাই।
তোমাকে পাওয়ার জন্য কি আমার একটা হাত কেটে ফেলতে হবে নাকি একটা পা?
আমি প্রয়োজনে গাড়ির নিচে মাথা দিয়ে মরবো,তবুও তোমাকে ছাড়া বাঁচব না তুলসি।
শুভ্রর কান্না আর এমন পাগলামি দেখে তুলসির চোখেও পানি এসে গেলো।একটা মানুষ কতটা ভালবাসলে অসহায়ের মতো এতো পাগলামি করতে পারে চোখের সামনে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না।বিধি তুমি বলে দাও আমি কি করবো।
হঠাৎ করে শুভ্র তুলসির পা জড়িয়ে ধরলো।আশে পাশে লোকজন আছে তবুও লজ্জা নেই শুধু তুলসির ভালবাসা ভিক্ষা চাই।অবশেষে তুলসি শুভ্রর ভালবাসা গ্রহণ করতে বাধ্য হলো।
মিষ্টি হাসি দিয়ে হাত ইশারা দিয়ে বললো “ভালবাসি তোমাকে”
শুভ্র তুলসির ডান হাত নিজের মাথায় নিয়ে বললো “তুলসি তুমি কসম কেটে বলো তুমি মা হতে পারবেনা”এই কথা কোনদিন আমার পরিবারের কাছে বলবে না।
বিয়ের পরে এই বিষয় নিয়ে যদি কোনোদিন কথা হয়, আমি বলবো আমার সমস্যার জন্য বাচ্চা হচ্ছে না। কিন্তু তোমার উপর আঙুল দিক কেউ এটা আমি চায় না।
তুলসি চোখের পানি ছেড়ে এবার শুভ্রর পায়ের কাছে বসে বললো তুমি এতো ভালো কেনো?বলোতো।
মানুষ কি এতো ভালো হয়?
তোমাকে না দেখলে জানতাম না পৃথিবীতে এতো ভালো মানুষ আছে।
তুলসিকে সাথে করে শুভ্র বোনের বাড়ি গেলো।বোনকে অনেক কষ্টে রাজি করালো বাবা মাকে বিয়ের কথা জানানোর জন্য।
আপু:শুভ্র তুই যত কথায় বলিস বাবা মা কোনো দিন জেনে শুনে সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চাইবে না।বাবা মা রাজি হবে না।তাছাড়া তুই বেকার সবে মাত্র পড়াশোনা শেষ করলি।তুই নিজেই বাবার টাকায় চলিস।বউকে কি খাওয়াবি।আবেগ দিয়ে জীবন চলে না।ভেবে দ্যাখ সামনে তোর পুরো জীবন পড়ে আছে।কিছুদিন কেটে গেলে এই আবেগ থাকবে না তখন বুঝতে পারবি কি ভুল করেছিস।
শুভ্র :আপু কিছু মনে করো না। একটা কথা বলি তুমি অবশ্যই আমার ভালো চাও বলেই এই কথা বলছো কিন্তু একটা কথা বলে রাখি আমি কোনোদিন তুলসির বিষয়ে অভিযোগ করবো না কাউকে অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না।আমি যেকোনো একটা চাকরি যোগাড় করবো।তুমি আর দুলাভাই শুধু বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তুলসির বাড়ি যাও।
আমি বিয়ে করে তারপর বাবা মায়ের সামনে যাবো না হলে তারা রাজি হবে না আমি জানি।
বিয়েতে কোনো মতেই তুলসির বাবা মা রাজি হয়না তারা জানে তাদের মেয়ের সমস্যা গুলো। কিন্তু শুভ্রর জোরাজোরিতে বিয়ে হলো।সেইদিন রওনা দিলো ঢাকায় নিজের বাসার উদ্দেশ্যে।
দীর্ঘ ছয় ঘন্ঠা সময় পরে গেটের সামনে গিয়ে কলিং বেলে চাপ দিলাম।বাবা-মা বোন তিনজন একসাথে হাজির।আপু ফোন করে বাবা মাকে বুঝিয়ে বলেছেন কিন্তু বোঝার মতো বিষয় না আমি জানি। তবুও শেষ চেষ্টা করতে হবে।
বাবা তো একবাক্যে বলে দিলো আমার বাড়ি কেউ যেনো না ঢুকে।এ বাড়ির দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ। আজ থেকে জানবো আমার শুধু দুইটা মেয়ে।কোনো ছেলে নেই।
একথা বলে নিজের রুমে চলে গেলো।আমি কোনো কথার জবাব দিতে পারিনি।মা শুধু চোখের ইশারায় বললো রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে আয়।
তুলসি কোনো কথা শুনতে না পারলেও বুঝতে পারছে তাকে নিয়ে অনেক সমস্যা হবে এই বাড়িতে।তবুও চুপচাপ থাকতে হবে শুভ্র পাশে থাকলে কোনো চিন্তা নেই আমার।
ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে যেতেই বাবা উঠে গেলেন না খেয়ে।
এভাবে প্রাই দিন বাবা খাবার রেখে উঠে যায়। খেয়াল করে দেখেছি আমি একা যদি তাদের সাথে খায় কোনো কথা না বললেও টেবিল থেকে উঠে যায় না। কিন্তু তুলসি ধারে কাছে এলেই উঠে চলে যায়।
তুলসি পরিস্থিতি বুঝতে পারে তার চোখ জোড়া পানিতে টলমল করে।
নিজেকে আমার বিরাট অপরাধী মনে হয়,তুলসিকে আমি যোগ্য সম্মান দিতে পারছি না। কোনো দরকারি কিছু লাগলেও দিতে পারছি না।শুধু পেটের খাবার।বাবা আমাকে আগে হাতখরচার টাকা দিতো যখন যা চাইতাম,বিয়ের পর সেই পথ একবারে বন্ধ।
এভাবে প্রাই দুইমাস কেটে যায়।
তুলসি নিজের মতো করে সংসারের সব কাজ করে।তবুও মন পায়না কারও।মা আর বোন তুলসির সাথেও খারাপ ব্যবহার শুরু করে।কোনো দরকার পড়লে এতো ডাকে কানে শোনে না।কিছু দরকার পড়লে তুলসির কাছে শোনে সে বলতে পারে না। হাজারটা অভিযোগ তুলসিকে ঘিরে।বোবাকালা মেয়ে তারা মানতে পারছে না।
এমনিতেই শীতকাল তার উপর তুলসির শ্বাসকষ্ট। প্রতিদিন ভোর সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠার আগেই আমি তুলসিকে সংসারের সব কাজে সাহায্য করি।কিন্ত বাড়ির কেউ যদি কোনোদিন আগে জেগে যায় তাহলে তো সাহায্য করতে পারি না।
এই কারনে তুলসি অসু্স্থ হয়ে পড়ে।চিকিৎসার জন্য একটা টাকাও দেয়না আর অসুস্থ হয়ে কাজ না করার জন্য আরও রাগারাগি করে।
অবশেষে আমার ধর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো।
আমি কাওকে কিছু না বলে তুলসিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম।
আর সিদ্ধান্ত নিলাম কোনোদিন আর এখানে ফিরবো না।
শূন্য পকেটে অসুস্থ তুলসিকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে লাগলাম কি করবো কোথায় যাবো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না।
অবশেষে আমার হাতের আংটির দিকে নজর পড়লো।
বিক্রি করে তুলসির ওষুধ কিনে রওনা দিলাম অজানা শহরের দিকে। বাস শেষ যেখানে থামবে ঐটা আমাদের গন্তব্য।তবুও এই শহরে থাকবো না যেখানে নিজের বাবা মা আপন না সেখানে কে আর পাশে থাকবে।
রাত তিনটার সময় গাড়ি থামলো অচেনা শহরে।
দোকান থেকে চা রুটি দুজনে খেয়ে বসে থাকলাম রাস্তার কিনারে।সকালের অপেক্ষা করছি কিছু একটা ব্যবস্হা নিশ্চয়ই হবে।
সকালে বাসা খুঁজতে শুরু করলাম।পকেটে যে টাকা আছে তাতে দামি কোনো বাসায় উঠে এডভান্স করার মতো টাকা নেই। উঠতে হবে কোনো বস্তিতে। শহর থেকে বেশখানিকটা দূরে আপাতত একটা থাকার জায়গা পেয়েছি।
তুলসিকে বললাম তুমি থাকো আমি কোনো কাজের সন্ধান করে আসি তা-না হলে আমরা কি খাবো আর তোমার ওষুধ কিভাবে কিনবো।
তুলসি অচেনা জায়গায় একা কিছুতেই থাকতে রাজি হচ্ছে না।কান্নাকাটি করছে ভয়ে। চারপাশের লোকজন কেমন যেনো।আর কয়েকটা বখাটে ছেলে আছেএখানে।দোকানে বসে নেশা করে জুয়া খেলছে।চাহনি ভালো না।
তুলসিকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে চলে আসলাম।কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে তুলসিকে হাজার ডাক দিলেও কানে শুনতে পারবে না দরজাও খুলতে পারবে না এজন্য।
তুলসি বার বার করে বলে দিয়েছে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে।
“পাগলী বোঝেনা তার জন্য আমার বেশি চিন্তা, বাইরে যতক্ষণ থাকবো মন থাকবে তার কাছে “।
শহরের মধ্যে মোটামুটি সব জায়গায় চাকরির খোঁজ করছি কোথাও শূন্য পদ নেই। মাসের মাঝামাঝি কাজে নিতে চাই না কেউ। কি করবো না করবো ভাবছি আর হাঁটছি।অন্য মনস্ক হয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে খানিকটা চোট লাগলো ইজিবাইকের ধাক্কা লেগে।পায়ে ব্যান্ডেজ করার জন্য একটা ক্লীনিকে গেলাম।
পায়ের ড্রেসিং শেষ করে আসার সময় কানে এলো ক্লীনিকের কতৃপক্ষ বলাবলি করছে তাদের একজন লোক লাগবে পরিস্কার পরিচ্ছন্য করার জন্য।
মনে মনে ভাবলাম আমি বলবো না আমি গ্রাজুয়েশন কম্প্লিট করছি তাহলে এই কাজটা আমাকে দেবে না।
আমি উনাদের কাছে গিয়ে হাতজোড় করে কাজটা চাইলাম।
আমার পোশাক দেখে তারা রাজি হয়নি প্রথমে বললো পোশাক পরিচ্ছদ দেখে তো ভালো পরিবারের ছেলে আর শিক্ষিত বলেই মনে হয় তাহলে এতো নিচু কাজ করতে চান কেনো।
আমি বললাম- অনেক গরীব ঘরের এতিম ছেলে আমি, পড়াশোনা জানিনা।আমার স্ত্রী অনেক অসুস্থ এই কাজটা আমার খুব দরকার।দয়া করে কাজটা আমাকে দেন।
অবশেষে কাজটা আমাকে দিলো।
আগামীকাল থেকে কাজ শুরু করতে হবে।কি কাজ নিলাম এটা মূল বিষয় না তুলসিকে ভালো রাখতে পারবো এটাই মূল বিষয়।আমি এই কাজ নিছি তুলসিকে বলবো না কষ্ট পাবে।খুশি মনে বাসায় ফিরে গেলাম,তুলসিকে গিয়ে বলছি ভালো চাকরি হয়েছে আমার,অনেক টাকা বেতন।
তুলসি খুব খুশি।
প্রতিদিন আটটায় ক্লীনিকে যায় আর রাত আটটায় বাসায় ফিরি মাঝে মধ্যে আরো বেশি রাত হয়ে যায় বাসায় ফিরতে।তুলসিকে সারাদিন জেলখানার কয়েদীর মতো বন্দি করে রেখে যায়।
এভাবে কেটে যায় মাসখানেক।
একদিন এক ভদ্র মহিলার সিজারিয়ান অপারেশন।হঠাৎ করে প্রেশার বেড়ে যায়,অতিরিক্ত ব্লীডিং আরো অনেক সমস্যা। পরিস্থিতি এমন হলো যে খুব দ্রুত কিছু ওষুধ লাগবে কিন্তু এখানে নেই এবং বাইরে থেকে আনবে এমন মানুষ নেই।সেই মুহুর্তে আমি ছিলাম পাশে।
বাইরে গিয়ে দ্রুত ওষুধ গুলো নিয়ে আসলাম।অপারেশন সাকসেসফুল হলো।
পরে সবাই বলছে আচ্ছা শুভ্র কে আমরা বলিনি কি ওষুধ লাগবে আর লিখেও দেয়নি ওষুধের নাম তাহলে কিভাবে সে প্রয়োজনীয় ওষুধ গুলো চিনে নিয়ে আসলো।
আমি আর মিথ্যা বলতে পারলাম না। বললাম-এই একমাস আপনাদের পাশে থেকে শিখে গেছি কখন কি ওষুধ লাগবে। এজন্য শিখে গেছি। আর ওষুধের নাম বলে নিয়ে আসছি।
ডাক্তার সাহেব বললেন সব ঠিক আছে কিন্তু শিক্ষিত না হলে এতো দ্রুত এতোটা অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব না।
আমি বললাম স্যার আমি গ্রাজুয়েশন কম্প্লিট করছি গতবছর।
সবাই একটু রাগ করলো আর বললো-এতোদিন আপনার সাথে তাহলে আমরা অন্যায় করছি আজ থেকে আপনি যোগ্যতা অনুযায়ী আমাদের ম্যানেজার।আর বেতন আরো বাড়িয়ে দিবো।আর আমাদের ক্লীনিকে স্টাফ রুম আছে আপনি চাইলে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতে পারবেন।
খুশিতে চোখে পানি চলে আসলো।বাসায় গিয়ে তুলসিকে কোলে তুলে নিয়ে নাচতে শুরু করলাম।
বললাম কাল থেকে আমরা দুজন দিনরাত একজায়গায় থাকতে পারবো তোমাকে আর সারাদিন একা থাকতে হবে না।বন্দি থাকতে হবে না বখাটের ভয়ে।
পরদিন সকালে তুলসিকে নিয়ে ক্লীনিকে চলে আসলাম।আমাদের সুখের সংসার শুরু হলো।আমি খুব খুশি তুলসির হাসিখুশি মুখটি দেখে।দেরি হলেও সুখ দিতে পেরেছি এটা ভেবেই শান্তি পায় আমি।
এভাবে কেটে যায় কয়েক বছর। শহর থেকে দূরে নদীর কূলে তুলসির পছন্দ মতো একটুকরো জমি কিনেছি,সেখানে ছোট্ট একটা ঘর করেছি।সুখেই কাটছিলো আমাদের জীবন।
সুখের ঘরে দুঃখের হাতছানি। তুলসি প্রচণ্ড পেটে ব্যথায় কান্নাকাটি শুরু করে ঠিক মতো খেতে পারে না বিছানা থেকে উঠতে পারে না এমন অসুস্থ।
ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম।ডাক্তার দেখার পর নার্স তুলসিকে রিপোর্ট করার জন্য পাশের রুমে নিয়ে গেলো।
ডাক্তার আমাকে বললো কিছু কথা জানার ছিলো যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলুন।আপনাদের বাচ্চা আছে? বললাম না ডক্টর।
ডাক্তার বললেন -আপনার স্ত্রী কোনোদিন মা হতে পারবেন না।এটা জানেন?উনার যে সমস্যা ছিলো এখন বড় আকারে ক্যানসারে রূপ নিয়েছে।
বাইরে থেকে উনাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু ভেতরে ভেতরে কিন্তু অনেক মারাত্মক সমস্যার মধ্যে আছেন।
এমন অবস্থায় রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা ১০%।
তবে আমাদের দায়িত্ব রোগী যতদিন বাচঁবে মানসিক ভাবে সুখে রাখা।
কোনো চাপ যেনো না পড়ে।আর এইসব কথা উনি যেনো কোনোদিন না জানে।
আমি ডাক্তারের কথা শুনছিলাম আর চোখের পানি অঝোরে ঝরছিলো মনে হচ্ছিলো পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে।চারিদিকে অন্ধকার দেখছি। যাকে এতো ভালবাসলাম পুরো পৃথিবীর বিপক্ষে রেখে তাকে ঘিরে বাঁচতেই চাইলাম সেই ফাঁকি দেবে আমাকে?
না এটা হতে পারে না।আমি তাকে ছাড়া বাঁচবো না।
ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করলাম কোনো অপারেশন কিংবা চিকিৎসা আছে? যেটা করলে তুলসি সুস্থ হয়ে যাবে।
যত টাকা লাগে আমি দিবো প্রয়োজনে নিজের দুটো কিডনি বিক্রি করে দিবো।তবুও টাকার যোগাড় করবো, আপনি শুধু চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
ডাক্তার বললেন -শুভ্র সাহেব আপনি শান্ত হোন।রোগীকে সুস্থ করা আমাদের দায়িত্ব, টাকা মূল বিষয় না।কিন্তু যেটা সত্য মানতেই হবে।
পরে তুলসিকে নিয়ে রিক্সায় করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।তুলসি ইশারা করছে তার কি হয়েছে? আমি কি জবাব দিবো তাকে।
বললাম অতিরিক্ত গ্যাসট্রিক বেড়েছিলো এজন্য অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলে এই ওষুধ গুলো নিয়মিত খাও ঠিক হয়ে যাবে।
আমি গোপনে চোখের পানি মুছি।কোনো কাজে মন বসে না
সারাক্ষণ তুলসির পাশে থাকি।
মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম।
তুলসি এতোটা অসুস্থ ওর বাবা মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। আমার বাবা মায়ের উপর রাগ করে সেই যে নিজের শহর ছেড়ে চলে আসলাম তার পরে আর কারও সাথে যোগাযোগ হয়নি।
তুলসিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আপন ঠিকানায়।বাবা মা ভীষণ খুশি আমরা যাওয়াতে।কাওকে না জানিয়ে এভাবে বাড়ি ছাড়া ঠিক হয়নি বললেন।
সন্তানের উপর বাবা মা রাগ করে এই কারণেই যাতে তার ছেলে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাই বলে বাড়ি ছাড়তে হবে বিষয়টা এমন না।
মেনে নিয়েছি তুলসির সাথে অন্যায় করেছিলাম, আমরা তার জন্য অনুতপ্ত। আমার একমাত্র ছেলে হয়ে তুই হারিয়ে যাবি আর আমরা কিভাবে এতোটা বছর চোখের পানি ফেলেছি তুই বুঝতে পারবি না।
তোর চোখ মুখের কি হাল কতকাল ঠিক মতো খাবার পেটে পড়ে না আর ঠিক মতো ঘুমোস না তার হিসাব নেই।
এভাবে বাবা মা অনেক কথা বললেন।
তুলসির আড়ালে বাবা মাকে সব বুঝিয়ে বললাম।তারাও কষ্ট পেলো সব কথা শুনে।তুলসির বাবা মাকে খবর দিলাম।
আজ দুই পরিবার এক হলো কিন্তু “যাকে নিয়ে আয়োজন সেই আমার প্রিয়জন,তাকে সারাজীবন আমার প্রয়োজন।”
কিন্তু পাখি না জানি কবে উড়াল দেয়।
আমি সব কিছু ভাবতে ভাবতে মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি। পরিবারের সবাইকে আমার বিরক্ত লাগে কাওকে সহ্য করতে পারছি না।কারো ভালো মন্দ কোনো কথায় আমার ভালো লাগে না। একসময় তুলসিকে আমি ঘৃণা করতে শুরু করি,কেনো জানি সামনে এলেই আমার মাথার মধ্যে ভীষণ যন্ত্রনা করে।তুলসি যে বেশিদিন বাঁচবে না, ওর মরার পরে আমি কিভাবে বাঁচবো এই ভাবনাটা আমাকে পেয়ে বসেছে।
একটা সময় আমি ঘরের জিনিস পত্র ভাঙতে শুরু করি হাতের কাছে যা পায় তাই ছোড়াছুড়ি করি।
তুলসির এতো কঠিন একটা রোগ সে বুঝতে না পারলেও আমার জন্য চিন্তা করতে থাকে। আমার হঠাৎ কি হয়ে গেলো।আমাকে তুলসি প্রচণ্ড ভালবাসে আমার জন্য সে চিন্তা করে করে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
আমার মানসিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে, রাস্তা ঘাটে যাকে পায় তাকেই মারি,ছোট বাচ্চাদের পানিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দি।বাবা মা অবশেষে অতিষ্ঠ হয়ে আর আমার শারীরিক অবস্থা দেখে মানসিক হাসপাতালে একেবারে সিফট করে দেয়।
আমাকে হসপিটালে পাঠানোর পর পরই তুলসি পাগলের মতো কান্নাকাটি করে।তুলসির শ্বাস কষ্ট শুরু হয়,পেটের ব্যথা শুরু হয়।এক কথায় মৃত্যু যন্ত্রনা শুরু হয়।কিছুক্ষণের মধ্যে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে।বিধির বিধান এতো কঠিন আমার নীলপ্রজাপতির প্রাণভ্রমর উড়ে গেলো আমি জানতেও পারলাম না দেখতেও পারলাম না।আর আমি যতটা মানসিক ভাবে অসুস্থ তুলসি নামে যে আমার জীবনে কেউ ছিলো বা আছে তা মনেই নেই।বাবা মা কি জিনিস তাই বুঝি না।
সদ্য জন্মানো একটা শিশুর মতো মনমানসিকতা আমার।মানসিক হাসপাতাল থেকে তিনবছর পর সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরি।আমার সব কিছু মনে পড়ে যায়।
বাবা মায়ের কাছে তুলসির কথা শুনি -সবাই নিরব, কি জবাব দেবে আমাকে?
অবশেষে তুলসির কবরের কাছে নিয়ে যায় আমাকে। আমি শুধু বাবা মা কে একটা কথায় বললাম তোমরা সবাই জানতে আমি ওকে কতটা ভালবাসতাম, তোমরা কি শেষ একটি বারের জন্যও আমাকে তুলসির লাশের কাছে আনতে পারতে না?
বাবা মা বললেন -শুভ্র একদিকে তুই অসুস্থ একদিকে তুলসি মারা গেলো আমরা কি করবো না করবো দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম।তবে তুলসি মরার পরে তোকে বাড়িতে এনেছিলাম তুই সেই মুহূর্তে শুধু তুলসির মরা মুখটা একনজর দেখার পরে বেহুশ হয়ে পড়েছিলি।তারপর তোকে আবার মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হলো।
তার পরের ঘটনা তো বুঝতে পারছিস।
তবে একটা কথা, তুই অসুস্থ থাকা অবস্থায় তুলসি রোজ তোর জন্য ডায়েরি লিখতো আর কাঁদতো।
ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ডায়েরি পড়া শুরু করলাম।
প্রাণের প্রিয় শুভ্র,
আমি পৃথিবীর সব থেকে ভাগ্যবতী নারী।যাকে তুমি নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালবাসো।একটা মেয়েকে একটা ছেলে এতটা ভালবাসতে পারে নিজের চোখে না দেখলে কোনদিন কেও বিশ্বাস করতে পারবে না।
আমাকে সুখী করতে পরিবারের বিপক্ষে চলে গেলে,আমাকে মানসিক ভাবে শান্তি দিতে আবার দুই পরিবারকে এক করলে।জানো শুভ্র আমি প্রথম দিনেই জানতে পেরেছিলাম আমার কি রোগ।কিন্তু তোমাকে বুঝতে দি নি।দিনের পর দিন
আমার জন্য কত আড়ালে কেঁদেছো আমি তোমার শুখনো মুখখানা দেখেছি,নিজেকে অসহায় লাগে জানো।
বিশ্বাস করো শুভ্র আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই না।আমি না থাকলে তুমি কিভাবে বাঁচবে এটা ভেবে বেশি কষ্ট পায়।
শুভ্র দিনের পর দিন তুমি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে গেলে। আমি তোমাকে ছুঁতেও পারি না,তুমি আমাকে সহ্য করতেই পারো না।
জানো শুভ্র খুব ইচ্ছে করে তোমার বুকে মাথা রেখে শান্তির একটা ঘুম দিতে।কতদিন তোমার ভালবাসা পায়না জানো।খুব ইচ্ছে করে তোমার চোখে নিজেকে হারাতে,তোমার হাতে একটু হাত রাখতে।
বিশ্বাস করো শুভ্র তোমাকে আমি তোমার থেকেও বেশি ভালবাসি।কিন্তু আমি বোবাকালা বলে তোমার প্রতি ভালবাসাটা হয়তো বলে প্রকাশ করতে পারিনা।
জানো?
আমার ইচ্ছে করে চিৎকার করে সারা পৃথিবীর মানুষকে বলি আমি তোমাকে ভালবাসি ভালবাসি ভালবাসি শুভ্র আমি তোমার বুকে সারাজীবন থাকতে চাই।
আমি মরতে চাই না শুভ্র, আমার একা থাকতে ভয় করে।তোমাকে ছাড়া কিভাবে একা থাকবো বলো।
আচ্ছা শুভ্র তুমি তো মানসিক ভাবে অসুস্থর জন্য আমাকে ভুলে আছো।কোনদিন যদি সুস্থ হয়ে ওঠো তখন কি আমার উপর অভিমান করবে তোমাকে না বলে চলে গেলাম সেজন্য?
রাগ করো না প্রিয়, নিজেকে সামলে নিও।আমি সব সময় তোমার সাথে থাকবো। আমার কথা মনে পড়লে ডায়েরিটা খুলে দেখো আর মাঝে মধ্যে কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে বসে থেকো আমি বৃষ্টি হয়ে তোমাকে ছুঁয়ে দিবো।
তোমার প্রাণের প্রিয়া
তুলসি
চিঠিটা পড়ে নিজেকে সামলাতে আমার একটু সময় লাগলো।তুলসিকে মনে সব সময় পড়ে। প্রথম দেখা সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে ডায়েরিটা খুলতেই
একটা নীলপ্রজাপতি উড়ে এলো আমার হাতের উপর।
আমি তুলসির ছোঁয়া অনুভব করলাম।