• সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ১০:৫৩ অপরাহ্ন

ছোটগল্প: কাজল রেখা

সাবিত রিজওয়ান / ৫৪ Time View
Update : সোমবার, ১৯ মে, ২০২৫

রকিবুল ইসলাম

বাবা মারা গেলেন সপ্তম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে। লেখা পড়া বা পরীক্ষার ক্ষতি এড়াতে বড় বোন আমাকে নিয়ে গেলেন তার শশুরালয়ে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।তাও আবার অল্প কিছুদিনের জন্য। সংসারে বাবার অনুপস্থিতিতে তখন অনটন চলছিল। আমাদের পরিবারের চাপ কমাতে বোন আমাকে নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে।বেশ চলছিল দিনগুলো।অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম যশোর রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে। আমার বন্ধু বলুন আর সহযাত্রী বলুন ছিল বড় বোনের ছোট ছেলে ও তার বড় ভাসুরের ছোট ছেলে।আমরা তিনজনই কাছাকাছি বয়সের ছিলাম।সখ্যতাটাও ছিল বেশ।ভালই কাটছিল দিনগুলো।অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর আবার স্ব গৃহে ফিরে আসি।নবম শ্রেণীতে ভর্তি হই হামিদ পুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পড়াশোনা ঠিক ঠাক হচ্ছে না এটা বুঝতে পেরে বড় বোন আবার আমাকে নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে। স্কুলে যাওয়া, পড়াশোনা,খাওয়া-দাওয়া আর খেলাধুলা এসবই ছিল প্রধান কাজ। আমার দুলাভাইয়ের অনেক সম্পত্তি।
চাল কিনতে হত না। বাগানের নারিকেল আর সুপারি বিক্রয় লব্ধ অর্থ আমার বোন নিজের কাছেই রেখে দিতেন।যতটা সম্ভব তিনি ওখান থেকেই আমার মা, ভাইদের সাহায্য করে গেছেন।বিরক্ত হচ্ছেন বোধকরি। খুব স্বাভাবিক।শোনাতে এলাম -“কাজল রেখা’র”- কথা অথচ শোনাচ্ছি অন্য কীর্ত্তন।ফরিদা আমার বড় বোনের খুব কাছের মানুষ এবং সে আমার ফুফু বাড়ির দিকেরও আত্মীয়া।একই পাড়ায় বসতি হওয়ার সুবাদে ফরিদা সকাল-সন্ধ্যা আমার বোনের কাছে ছুটে আসত।আজ আপনাদেরকে যার কথা বলছি সে আর কেউ নয় এই ফরিদা আপার ছোট বোন।সে প্রায়ই বেড়াতে আসত ফরিদা আপার বাসায়।এখানে এলে আমার বোনের বাসায়ও আসত নিয়ম করে।আমার সমবয়সী ভাগ্নে/ভাগ্নি দের সাথে তার সম্পর্কটা ছিল খুব মধুর। একদিন অপরাহ্নে ঘুম ভেঙে হঠাৎই দেখলাম তাকে।
রুপা কে জিজ্ঞাসা করলাম (রুপা আমার ভাগ্নি)!কে এটা?! রুপা বলল:ফরিদা খালার ছোট বোন।বেড়াতে এসেছে। পরিচিত হলাম তার সাথে।মিন্টু,বাবু,রুপার মত আমার সাথেও তার একটা সখ্যতা তৈরি হল। আমাদের রসায়নটা ছিল বেশ। বিকালে এলে আমাদের সাথে কখনও নারিকেল বাগান আবার কখনও ক্ষেতের আইলে বসে আড্ডা দিতাম আমরা।এবার কাজল রেখা বেশ কয়েকদিন থাকবে বলে এসেছিল।এক পর্যায়ে ওকে আমার ভাল লাগতে শুরু করল। আপনারা ভাবতে পারেন এতটুকু বয়সে আবার কিসের ভাললাগা!? কিন্তু, ছোট বেলা থেকে যে ছেলেটা এলাকার বড় ভাই-বোন দের প্রেমের চিঠি বিলি করত তার পক্ষে অকালপক্কতা অস্বাভাবিক কিছু নয়।যাক সে সব কথা।কচি বয়স তখন,এজন্য বড়দের মত কোন কিছু গোপন রাখতে পারিনি।বাবু,মিন্টু,রুপা সকলেই জেনে গেল ব্যাপারটা।ওরা তখন সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছিল বন্ধুর বেশে।আমিও ধীরে ধীরে মনের মাঝে সাহস সঞ্চার করে এগোতে লাগলাম তার দিকে।অন্যরা যখন খেলাধুলায় ব্যাস্ত থাকত তখন আমি ও সে মেতে থাকতাম গল্প, আড্ডায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত তার সাথে সময় কাঁটিয়ে ঘরে ফিরে পড়তে বসতাম। আমার বোন কিছুই আঁচ করতে পারেননি প্রথমে।ফরিদা আপা বিষয়টি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। একদিন আমাকে তার বাসায় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন!-কি ব্যাপার!এসব কিন্তু ভাল নয়। তোমরা এখন অনেক ছোট।আর তাছাড়া তোমার বোনও মেনে নিবেন না বিষয়টি।পাছে আমার ও তোমার বোনের মধুর সম্পর্ক নষ্ট হবে তোমাদের কারণে।তাকে বোঝানোর মত অতটা পরিপক্কতা তখনও আসেনি আমার মধ্যে।চলে এলাম ওখান থেকে।কে শোনে কার কথা!এটা কি বাঁধা মানার বয়স!আমি ও কাজলা দিদি (কাজল রেখা) আমাদের মত করেই এগোতে থাকলাম।নিয়ম করে দেখা করা,গল্প ,আড্ডা এই সবই চলতে লাগল। কিন্তু,বিধি বাম।ফরিদা আপা বিষয়টি আর এগোতে দিলেন না। একদিন বিকালে নারিকেল বাগানে বসে গল্প করার সময় উনি কাজল রেখাকে নিয়ে চলে গেলেন।আমাকে বলে গেলেন -এসব ভাল নয়। নিজের মান বাঁচাতে ও বন্ধুত্ব রক্ষার্থে উনি আমার বোনকে সবটাই বলে দিলেন অবশেষে। ফলাফল স্বরুপ কাজল রেখা তার বাসায় আর আমি আমার বাসায় ফিরে এলাম।ফিরে এলাম নয় ফেরত পাঠানো হল।আমার বোন এসব প্রণয় ঘটিত ব্যাপারে খুব কঠোর একটা মানুষ।মাঝে অনেক দিন গত হল তার সাথে দেখা হয় না,কথা হয় না।সে এখন কখন যে বেড়াতে আসে তাও জানতে পারি না।তবে,যখন বোনের বাসায় যেতাম রুপা,বাবু, মিন্টু বলত ছোট খালা এসেছিল।আমার কাজলা দিদিকে ওরা ছোট খালা বলে সন্মোধন করত।আমি জিজ্ঞাসা করতাম আমার সম্পর্কে কি কিছু বলেছে।বলেছে মানে কি! কয়েকটি চিঠিও আছে। মোবাইল ফোন ছিল না তখন।চিঠিই একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ছিল। চিঠিগুলো পড়লাম। কিছু চিঠিতে নব্বই দশকের জনপ্রিয় নায়ক অকাল প্রয়াত সালমান শাহ্ অভিনিত সিনেমার গান,আবার কোন চিঠিতে ছিল তার সুন্দর ঠোঁট যুগলের লিপস্টিক মাখা ছাপ। এভাবেই চলতে লাগল দিন।এর মধ্যে ঘনিয়ে এল আমার এস,এস,সি পরীক্ষা।বড় বোন আবার আমাকে নিয়ে এলেন তার বাসায়‌।টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট খুব ভাল হয়নি যে।আমি,বাবু, মিন্টু সকলেই ঝাপিয়ে পড়লাম পরীক্ষার প্রস্তুতিতে।পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল।পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে আমার কাজলা দিদি একবার বেড়াতে এলেন। নারিকেল বাগানে গিয়ে আমরা সকাল -বিকাল খোলা হাওয়ায় পড়তাম। সবগুলো পরীক্ষা শেষের পথে ছিল শুধু কৃষি শিক্ষার প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা বাকি ছিল।কাজলা দিদি এবার এসেছিলেন তার এক বান্ধবী ও তার বয়ফ্রেন্ডকে সাথে নিয়ে। এসেছিললেন নিউ মার্কেট পার্কে।কৃষি শিক্ষার প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা ছিল পরদিন বিকালে।তার আগের দিন প্রেয়সীর দর্শন,ভাবা যায়!কার কাছে যে মহারাণী তার আসার খবরটি আমাকে পাঠিয়েছিলেন ঠিক মনে নেই। মিন্টু তখন তার বোনের বাসায় বারান্দী পাড়াতে। শেষ কয়েকটি পরীক্ষার পূর্বে তার বোনও তাকে নিয়ে গিয়েছিল তার নিজের বাসায়।যাইহোক, একদিকে আমাদের পরীক্ষা অন্যদিকে তারা এসেছিলেন মণিহার সিনেমা হলে সালমান শাহ্ এর সিনেমা দেখবেন বলে। তাদের ইচ্ছা ছিল দুপুরের শো’য়ে সিনেমা দেখে ওখান থেকেই নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাবে। সকালে একটু ঘোরাঘুরি তারপর সিনেমা দেখে বাসায় যাবেন এটাই ছিল প্লান। আমি,বাবু সকালে পূর্ব নির্ধারিত সময়ে নিউ মার্কেট পার্কে হাজির।মিন্টু এসেছিল বারান্দী পাড়া থেকে।আমরা সকলে পার্কের মধ্যে এক সাথেই হাঁটছিলাম।বাবু,মিন্টু ও তার বান্ধবী আমাদেরকে একটু সুযোগ করে দিতে আলাদা হয়ে গেল।মিন্টু ও বাবু একসাথে,কাজলা দিদির বান্ধবী ও তার বন্ধু দুজন একসাথে আর আমরা দুজন একসাথে কিছুটা মধুর সময় পার করলাম।এরপর আমরা ওখান থেকে রওনা করে এলাম মণিহার সিনেমা হলের উদ্দেশ্যে।মিন্টু একটু আগেই চলে গিয়েছিল। ঐ দিন দুপুর দুইটার সময় ওর একটা পরীক্ষা ছিল।বাবুও আমাদের সাথে এলো না।ও চলে গেল ওর নানির বাসায় অর্থাৎ আমাদের বাড়িতে।বাকি রইলাম আমরা চার জন।বাবু বাড়িতে ফিরে এসেছিল বিকালে।আমরা সিনেমা শেষ করে ফিরেছিলাম।বলে রাখি আমার বোনের বাসা আর আমাদের বাসা মাঝে একটা গ্রাম দূরত্বে।এই কারণে আসা-যাওয়াতে খুব একটা সমস্যা হত না। যাইহোক,আমরা আমাদের মত করে রওনা করলাম সে তার বোনের বাসা আর আমি আমার বোনের বাসার উদ্দেশ্যে। পরদিন পরীক্ষা ছিল বিধায় আমি আর নিজের বাড়িতে যাইনি।আমরা সকাল বিকাল যে বাগানে বসে পড়ি তার পাশের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে অদূরেই ফরিদা আপার বাসা।ওরা চলে গেল ওর বোনের বাসায় আর আমি ফিরে এলাম আমার বোনের বাসায়।বাবু আর আমার ফেরার ক্ষণে পার্থক্য হওয়াতে বোন সন্দেহের চোখে তাকিয়ে ছিলেন। কিন্তু, কিছু বলেননি।উনি খুব বাস্তববাদী মানুষ! পরদিন পরীক্ষা।বকলে যদি পরীক্ষা খারাপ হয় এই ভয়ে আর বকাঝকা করেননি সেদিনকার মত। বিকালে নারিকেল বাগানে এসেছিলাম কৃষি শিক্ষার থিয়রি পড়ব বলে।রথ দেখার সাথে সাথে কলাটাও বেঁচা হবে। কিন্তু,দর্শন তার এই বেলায় আর মিলল না।সন্ধ্যার পূর্বে বাসায় ফিরে আবার সন্ধ্যায় পড়তে বসলাম।কাজলা দিদি আর আমি দুইজনেই দুজনকে চিঠি লিখলাম। পরদিন সকালে ওরা ফিরে যাবে এটা জেনেই আমি সকালে যথারীতি ঐ নারিকেল বাগানেই পড়তে বসেছিলাম।ওরা যখন আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন কাজল রেখার বোনও এসেছিল তাদের পিছে পিছে বিদায় জানাতে।আমার সাথে যেন সে দেখা না করে সেটাও হতে পারে বোধকরি।ও যখন ওর বোনের ভয়ে ভীত না হয়ে আমার হাতে চিঠিটি গুঁজে দিতে গেল আমিও তখন তাকে লেখা আমার চিঠিটিও তার হাতে গুঁজে দিলাম।পিছন থেকে ফরিদা আপা দূর থেকে চিৎকার করে উঠলেন:এই কি ব্যাপার!এই বলে।আমরা হকচকিয়ে গেলাম বটে কিন্তু সাত-পাঁচ কিছু না ভেবেই আমি তার সাথে গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে এগিয়ে গেলাম কিছুটা পথ পর্যন্ত।শেষ বিদায় বলে কথা! কেঁদে ছিলাম সেদিন।সে ও।আর তারপর,,,,!তারপর আমার পরীক্ষা শেষ। বাড়িতে ফিরে এলাম।মনটা তার জন্য ছটফট করতে লাগল। আমি আর পলাশ( আমার চাচাতো বোনের ছেলে) একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম ওদের বাসা ঝিকরগাছায় যাব। যে কথা সেই কাজ।আমরা গেলাম সেখানে।বাড়ি চিনতাম না।তবে গ্রামের নাম,পিতার নাম জানা থাকলে বাড়ি চিনতে খুব একটা সমস্যা হয় না। আমরা ভয়ে তার বাসায় যাইনি।কাজল রেখার বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কপোতাক্ষ নদ।আমরা তার তীরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাড়িতে কাকে যেন একজনকে দিয়ে সংবাদ পাঠালাম তাকে আসার জন্য।টোকন এল।ওর বোন ফরিদা আপার ছেলে।এসে বলল:খালা তো মণিরাম পুরে বেড়াতে গিয়েছে।বাসায় নেই। কিছুটা অবিশ্বাস আর দ্বন্দ্ব মনে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম।তার সাথে আর কভু দেখা হয়নি।শুনেছি, সাতক্ষীরায় একটা ব্যবসায়ী ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছিল।স্বামী-সন্তান নিয়ে হয়ত সুখেই আছে সে! আচ্ছা!আমার মত তারও কি মনে পড়ে যায় আমাকে? রাতের আকাশে অসারিবদ্ধ তারাদের মিছিলের মাঝে সে কি আমারে খুঁজে চলে অহর্নিশি? অবুঝ অবোধ আমার মনের ইচ্ছেটা আজও চেয়ে থাকে ঐ দূর গগন পানের নক্ষত্রপুঞ্জের মাঝে। যদি সে কভু আসে আকাশের তারা হয়ে দেখতে আমারে!আমিও তখন দেখব তারে নয়ন ভরে।সে যে “কাজল রেখা!”-আছে সে আমার অক্ষিপুঞ্জ মাঝের গোলকে। ভুলি গো বলো তারে কেমন করে!

Facebook Comments Box


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
bdit.com.bd