মো. আকিবুল ইসলাম
গাজা ভোরবেলায় শান্ত এবং স্তব্ধ।
যেন ধ্বংসস্তূপের ওপরও ঘুম নেমে আসে। ধ্বংস হওয়া ভবনের ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে এক শিশু তার নাম গজনী। বয়স মাত্র সাত, কিন্তু চোখে যেন শত বছরের ক্লান্তি।
তার মা মারা গেছে এক বোমা হামলায়। বাবা হারিয়ে গেছেন অনেক আগেই রক্তাক্ত এক প্রতিবেশীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি আর ফেরেননি।
গজনী এখন থাকে তার নানির সঙ্গে; যার কাছে বেঁচে থাকার সংগ্রামটাই প্রতিদিনের রুটিন।
নানির কাছে একটি পুরনো ট্রাঙ্ক আছে। সেই ট্রাঙ্কে রাখা আছে গজনীর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু একটি ছেঁড়া, নীল রঙের ডায়েরি। ওটি তার মায়ের লেখা।
প্রতিদিন গজনী সেই ডায়েরির পাতাগুলো উল্টে-পাল্টে দেখে, যেন মায়ের কণ্ঠস্বর ফিরে আসে পাতার শব্দে।
একদিন ডায়েরির ভাঁজে খুঁজে পেল একটি পুরনো ছবি মায়ের সঙ্গে তোলা। ছবিটি দেখে গজনীর চোখ ভিজে যায়। সে কাঁদতে কাঁদতে নানিকে জিজ্ঞেস করে, “নানি, আমরা আবার কবে ফিরে পাবো স্বাধীনতা? স্বাধীনতার দিন কখন আসবে?”
নানি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। চোখের কোণে জমে ওঠা জল লুকাতে পারেন না। তারপর বলেন, “তোমার মা তখনও বিশ্বাস করত, একদিন আসবে। তুমিও বিশ্বাস করো।”
একদিন গজনী নানির সঙ্গে খাদ্যসামগ্রী আনতে যায়।
সেখানে তার দেখা হয় একটি ছেলের সঙ্গে নাম আমির।
দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে গভীর বন্ধুত্ব। আমিরের একটি ছোট রেডিও ছিল। প্রায়ই সেই রেডিওতে ভেসে আসতো খবর।
গজনী প্রায়ই যেত আমিরের বাসায়, খবর শুনতে।
ওরা স্বপ্ন দেখত এক মুক্ত ভবিষ্যতের যেখানে থাকবে না ধ্বংস, থাকবে শুধু শান্তি আর সাহস।
কিন্তু একদিন গজনী দেখতে পেল বোমার আঘাতে আমিরের বাড়ি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, কেবল একটা জিনিস অক্ষত ভাঙা রেডিওটা। গজনী সেটি তুলে নিয়ে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। কান্না থামে না, তবুও এক সময় সে নিশ্চুপ হয়ে যায়। হৃদয়টা কঠিন হয়ে ওঠে।
কিছুক্ষণ পর, আকাশ কাঁপিয়ে আরেকটি বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। গজনীর মনে পড়ে নানির কথা।
সে দৌড়ে চলে যায় বাড়ির দিকে।
ফিরে এসে দেখে চারপাশ ধোঁয়ায় ভরা, মানুষ ছুটছে এদিক-ওদিক, কেউ প্রিয়জনকে খুঁজে পাচ্ছে না, কেউ মাটিতে গড়াগড়ি করছে শোকে।
গজনী দেখতে পেল তার নানির নিথর দেহ পড়ে আছে এক কোণে। চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে পারছে না সে। তার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে।
হঠাৎ চোখে পড়ে তার মায়ের সেই প্রিয় ডায়েরিটি পড়ে আছে ধ্বংসস্তূপের নিচে, আধপোড়া অবস্থায়।
আর সেই ছবিটা মায়ের সঙ্গে তোলা অর্ধেক পুড়ে গেছে।
গজনী হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায়।
ছবিটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। ডায়েরির বাকি পৃষ্ঠাগুলো তুলে বুকের ভেতরে লুকিয়ে ফেলে।
যেন এই শেষ স্মৃতিগুলোও হারিয়ে না যায়।
ব্যক্তিগত পরিচয়পত্র :
নাম: মো. আকিবুল ইসলাম
অধ্যয়নরত (বাংলা) স্নাতক (সম্মান)
সরকারি আলিমুদ্দিন কলেজ।
গ্রাম: বড়খাতা
উপজেলা: হাতীবান্ধা
জেলা: লালমনিরহাট।