লেখক: মীর ফয়সাল নোমান
ঢাকার এক কোণায়, পুরান শহরের ধুলো-ধূসর রাস্তায় প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় জেগে ওঠে গাফ্ফার। বয়স পঁইত্রিশ, গায়ের রং পুড়ে যাওয়া পিচকালো, শরীর কুঁজো হতে বসেছে রিকশা চালাতে চালাতে। তার জীবন তিন চাকার এক রিকশার সীটে আটকে আছে—সেই চাকা ঘুরে যায়, জীবনটা ঘুরে না।
একসময় ছিলো গাফ্ফার গ্রামে একজন কৃষক। বাবার জমি ছিলো সামান্য, কিন্তু সুখ ছিলো বড়। বন্যায় জমি ভেসে গেলে শহরে চলে আসে। প্রথমে ভ্যানে করে ফল বিক্রি করত। পরে একদিন রিকশা ভাড়া নেয়—সেই যে শুরু, থেমে নেই।
প্রতিদিন গরমে, বৃষ্টিতে, ধোঁয়ায়, ধুলোয় গাফ্ফারের দিন যায়। যাত্রী কেউ “ভাই”, কেউ “ওই”, কেউ আবার রিকশায় বসেই বলে, “জলদি চালাও, দেরি হয়ে যাবে!” কেউ তার ক্লান্ত মুখের দিকে চায় না। কেউ ভাবে না এই লোকটারও ঘরে একটা মেয়ে আছে, যার স্কুলের ফি দিতে না পেরে রাতে ঘুম আসে না।
একবার তার মেয়ের জ্বর ওঠে। গাফ্ফার সারা দিন রিকশা চালিয়ে ৮৫০ টাকা রোজগার করে, তার ৫০০ টাকা খরচ হয় ওষুধে। বাসায় ফিরে মেয়ে যখন বলে, “আব্বু, তুমি কী খেয়েছো?”, তখন গাফ্ফার বলে, “রুটি খেয়েছি।” অথচ আসলে সারাদিন কিছুই খায়নি।
তবু সে থেমে না। প্রতিদিনই সে চালায়। তার স্বপ্ন—মেয়েকে মানুষ করা। “যেন সে রিকশা না চালায়, যেন সে শহরের মানুষদের পেছনে না ছোটে, যেন সে সামনে হাঁটে—সোজা মাথা তুলে।”
একদিন হঠাৎ তার রিকশায় উঠে এক সাংবাদিক। তারা গল্প করে। গাফ্ফার নিজের জীবনের কথা বলে। কিছুদিন পর সেই সাংবাদিক একটা লেখা ছাপে—”তিন চাকার জীবন” নামে। সেই লেখা পড়ে অনেকেই গাফ্ফারের পাশে দাঁড়ায়। মেয়ের পড়াশোনার দায়িত্ব নেয় এক এনজিও।
গাফ্ফার তখনো চালায় রিকশা, তবে তার মুখে এক টুকরো হাসি—এই হাসি যেন ঢাকার হাজার রিকশাওয়ালার এক রকম জয়ের প্রতীক।