মো. সোহাগ মোল্যা (মঈনুল)
নড়াইলের শান্তিপ্রিয় উপজেলায় সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার কাহিনী
নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলা—বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক শান্তিপ্রিয় অঞ্চল। নদী-নালা, সবুজ মাঠ আর জনজীবনের সরলতায় সুপরিচিত এই স্থানটির নাম এখন শঙ্কা আর দুঃখের সঙ্গে জড়িয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে শুরু করে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত হয়েছে একের পর এক নির্মম হত্যাকাণ্ড, যা এলাকাবাসীর মনোবল ভেঙে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ায় প্রশাসনের প্রতি তাদের আস্থা নষ্ট হচ্ছে। শান্তির বদলে কেবল রক্তপাতের ছবি ফুটে উঠছে এই ছোট শহরের প্রত্যেক গলি ও মহল্লায়।
জানুয়ারির শীতল রক্তপাত: তামিম আহম্মেদের নির্মম মৃত্যু
২০২৫ সালের ৫ জানুয়ারি লোহাগড়া উপজেলার মশাঘুনি গ্রামে ঘটে এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। মাত্র ১৩ বছর বয়সী তরুণ ভ্যানচালক তামিম আহম্মেদ খানকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় এবং মাটিচাপা দেওয়া হয়। তরুণটির অকাল মৃত্যুর ঘটনায় পুরো এলাকা স্তব্ধ হয়ে পড়ে।
পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে তদন্ত শুরু করলেও তামিমের পরিবারের চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়া থামেনি। হত্যার পেছনে বিরোধ ও পূর্ব শত্রুতার জোর গুঞ্জন শোনা যায়। এই হত্যাকাণ্ড ছিলো লোহাগড়ার মানুষের জন্য প্রথম শক্ত ধাক্কা, যা পুরো বছরের সহিংসতার সূচনা করে।
মার্চ মাসের কাঁপানো ঘটনা: চার বছরের শিশু শাহাদাতের নির্মম মৃত্যু
মার্চ মাসেও লোহাগড়ায় নির্মমতা থামেনি। ১৩ মার্চ এলাকায় নিখোঁজ হওয়া চার বছর বয়সী শিশু শাহাদাতের মরদেহ মাটি চাপা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
শিশুটির পরিবারের অভিযোগ, হত্যাকাণ্ডে সৎ দাদির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই ঘটনার ফলে এলাকা জুড়ে শোক ও আতঙ্ক বিরাজ করে। শিশুর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ ও হতবাক হন।
এই ঘটনা যেনো লোহাগড়ার ছোট্ট শিশুদের জন্যও নিরাপত্তাহীনতার সঙ্কেত বয়ে নিয়ে আসে।
এপ্রিলের কঠোর বিচার: শিশুদুর্নীতির শাস্তিশিশু নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির নজির স্থাপন হয় ৩০ এপ্রিল।
শামুকখোলা গ্রামের সাড়ে চার বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ ও শ্বাসরোধে হত্যা করার দায়ে তার চাচাতো ভাই হৃদয় বৈরাগীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের অতিরিক্ত কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত।
এই রায় ছিলো লোহাগড়ার জন্য এক আশার আলো, যা অপরাধীদের জন্য সতর্কতা স্বরূপ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এর আগে ঘটে যাওয়া অপমান ও হত্যার হাত থেকে শিশুদের রক্ষা করা যায়নি।
মে মাসের রক্তাক্ত দিন: তিনটি নির্মম হত্যাকাণ্ড
মে মাসে লোহাগড়া উপজেলায় ভয়াবহতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়।
১০ মে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তফা কামালকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আরও দুজন গুলিবিদ্ধ হন। রাজনৈতিক শত্রুতার জেরে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ড এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
১১ মে নোয়াগ্রাম ইউনিয়নের শামুকখোলা গ্রামের যুবদল কর্মী ও বালু ব্যবসায়ী সালমান খন্দকারের মরদেহ বিল থেকে উদ্ধার করা হয়।
১৪ মে ইতনা ইউনিয়নের পার ইছাখালী গ্রামের কৃষক খাজা মোল্যাকে প্রতিপক্ষের লোকজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।
এই তিনটি হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত শত্রুতার প্রভাব আছে বলে জানা গেছে। সাধারণ মানুষ বলছেন, প্রতিদিনই যেন মৃত্যুর ছায়া তাদের ঘিরে ধরে।
জনজীবনে অস্থিরতা ও প্রশাসনের চ্যালেঞ্জ
এসব হত্যাকাণ্ডের কারণে লোহাগড়া উপজেলায় শঙ্কা, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। এলাকার সাধারণ মানুষ এখন বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন, স্কুল-মাদ্রাসায় পড়ুয়ারা নিরাপদ নয় বলেই অভিভাবকদের উদ্বেগ।
অপরাধীদের দ্রুত বিচার ও কঠোর শাস্তি না হলে এলাকাটি আরও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা।
স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ একাধিক অভিযান পরিচালনা করলেও, অপরাধমূলক ঘটনা বন্ধে তা যথেষ্ট নয় বলেও অভিযোগ উঠেছে।
রক্তে জর্জরিত লোহাগড়া একটি সংকেত আমাদের সকলের জন্য—শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতিরক্ষা ছাড়া উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়।
সরকার, প্রশাসন ও স্থানীয় নেতাদের দায়িত্ব, লোহাগড়া যেন আর কখনো রক্তাক্ত না হয়। শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবার সম্মিলিত প্রয়াস দরকার।
লোহাগড়ার মানুষ আজ শান্তির প্রত্যাশায় বুক বাঁধছেন। তারা চায়, একদিন তাদের শহরটি ফিরে পাবে শান্তি ও আনন্দের আলো।
“রক্তের বদলে হাসি আসুক, আতঙ্কের বদলে স্থিরতা ফিরে আসুক”—এটাই তাদের কামনা।
সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি: আহমেদ হোসাইন ছানু। উপদেষ্টা সম্পাদক: মোঃ রহমত আলী। উপদেষ্টা: মোঃ জাবেদুল ইসলাম। সম্পাদক ও প্রকাশক: মোঃ রেজন মিয়া। কার্যালয়: উত্তর উল্যা, ভরতখালী, সাঘাটা, গাইবান্ধা, বাংলাদেশ। মোবাইল: 017013680087