গ্রামের নাম “নিমতলা”। চারিদিকে কাঁচা রাস্তা, খোলা মাঠ, আর পুকুরপাড়ে জমে থাকা গল্পের আসর। কিন্তু এই সাজানো গ্রামের বুকে জমে আছে শত বছরের কুসংস্কারের স্তর। গাছের ডালে বাঁধা লাল কাপড়, রাস্তায় উল্কি আঁকা মন্ত্র, অসুখে ঝাড়ফুঁক—এসব যেন নিমতলার নিত্যদিনের সঙ্গী।
অগ্নিপরীক্ষার সূচনা
মেঠো পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিল অনিলা। স্কুলের ইউনিফর্ম পরা চোদ্দো বছরের মেয়েটির হাতে একগোছা বই। বাড়ি ফেরার পথে রামকান্ত দা’র দোকান থেকে ডাক আসলো: “অনিলা, আজও এত দেরি? তোর বাবা তো তিন দিন ধরে জ্বরে পড়ে! ওঝা ডাকবি না?”
অনিলার গলা শুকিয়ে এল। বাবা শ্যামল চন্দ্র দাসের জ্বর কাঁপুনি দিয়ে শুরু হয়েছিল। গ্রামের ওঝা নিতাই পাল বলেছিলেন, “বাড়ির দক্ষিণ কোণের ছায়া পড়েছে, ভূতের আছর। গোবর-গোমূত্র ছিটিয়ে পূজা দিতে হবে।” কিন্তু বাবা দিন দিন দুর্বল হচ্ছেন।
“বাবাকে হাসপাতালে নেবো,” অনিলা জিদ ধরলো রাতে মায়ের কাছে।
মা করুণা দেবী চোখের জল মুছে বললেন, “ওঝা বলেছে, ওষুধ খেলে ভূত রাগ করবে। তুই মেয়েমানুষ, তোকে কি বোঝাব!”
সেই রাতেই শ্যামল চন্দ্রের শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। নিমতলা গ্রামের মানুষ জড়ো হলো তাদের বাড়ির আঙিনায়। নিতাই পাল এনে দিলেন গাঁজার ধোঁয়া, গলায় বাঁধলেন কালো সুতো। ভোর হওয়ার আগেই শ্যামল চন্দ্রের দেহ ঠান্ডা হয়ে গেল। ডাক্তারি ভাষায় যা টাইফয়েড জ্বর, গ্রামের ভাষায় তা হয়ে রইল “ভূতের প্রতিশোধ”।
বাবার মৃত্যুর পর অনিলার মনে জমা হতে থাকলো অগ্নিকণা। মায়ের জোরাজুরিতে স্কুল না ছাড়লেও গ্রামের লোকের কথা শুনতে হলো: “মেয়ে বেশি পড়াশোনা করলে সংসার নষ্ট করে।”
একদিন স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষক বললেন, “জ্বর হলো ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ, ভূতের ব্যাপার নয়।” অনিলা প্রশ্ন করলো, “স্যার, তাহলে আমাদের গ্রামে ডাক্তার কেন নেই?” শিক্ষক হেসে বললেন, “ডাক্তার আসবে যখন তোমরা ওঝাদের হাত থেকে মুক্তি চাইবে।”
সেই দিন থেকে অনিলা প্রতিজ্ঞা করলো: সে ডাক্তার হবে। নাহয়, নার্স হবে। যেভাবেই হোক, গ্রামের মানুষকে বাঁচাবে।
অন্ধকারের যাত্রী
অনিলার বিয়ে ঠিক হলো আঠারো বছর বয়সে। পাত্র রবিন, প্রতিবেশী গ্রামের যুবক। বিয়ের রাতেই রবিন বললো, “স্ত্রীর কপালে সিঁদুর পরালেই স্বামীর আয়ু বাড়ে—এসব মেনে চলবি তো?”
কিন্তু অনিলার ভাগ্য বদলালো অন্যভাবে। বিয়ের এক মাস পরই রবিন জ্বরে পড়লো। শ্বশুরবাড়ির লোক ডাকলো নিতাই পালের শিষ্যকে। অনিলা চেঁচিয়ে বললো, “ওষুধ দিতে হবে! নইলে সে মারা যাবে!”
গ্রামের বুড়োরা হৈ চৈ করলো: “বউ ডাকিনীবিদ্যা শিখেছে!” রবিনের অবস্থা ক্রিটিক্যাল হওয়ায় শেষমেশ তাকে জেলা হাসপাতালে নেওয়া হলো। ডাক্তার বললেন, “ম্যালেরিয়া। আর এক ঘণ্টা দেরি হলে…”
সেই ঘটনার পর অনিলা ঘর ছাড়লো। শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে শহরে গেলো। দিনে কাজ করতো একটি ক্লিনিকে, রাতে পড়তো নার্সিংয়ের বই।
পাঁচ বছর পর অনিলা ফিরে এলো নিমতলায়—সাদা ইউনিফর্ম পরা একজন প্রশিক্ষিত নার্স। গ্রামের লোকজন তাকে দেখে হাসে: “ঐ দেখো, ডাকিনী বৌ ফিরেছে!”
কিন্তু অনিলার প্রথম পরীক্ষা এলো দ্রুত। প্রতিবেশী তুলসীর ছেলে অরুণের জ্বর হলো। গ্রামের ওঝা বললেন, “বাড়ির উঠানে কাটা বাঁশ পুঁতে রাখো।” অনিলা গেলো তুলসীর ঘরে: “দিদি, ওষুধ দিই। এটা টাইফয়েড, বাঁশ পোঁতায় সারবে না।”
তুলসী ভয়ে কাঁপছিল: “তুই যদি ভুল করিস? ভূত রেগে গেলে?”অনিলা বললো, “ভূত না, ব্যাকটেরিয়াকে মারব।”
তিন দিনের মধ্যে অরুণ সুস্থ হয়ে উঠলো। গ্রামে whispers ছড়ালো: “অনিলার হাতে জাদু আছে!”
যুদ্ধের ময়দান
অনিলা শুরু করলো ছোট্ট একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র—গ্রামের পরিত্যক্ত কো-operatives ভবনে। প্রথম রোগী এলো এক বৃদ্ধা, যার পায়ে ঘা: “ওঝা বলেছে, শনির দৃষ্টি। গোবর লাগাতে বলেছে।”
অনিলা পরিষ্কার করলো ঘা, অ্যান্টিবায়োটিক দিলো। সপ্তাহে ঘা সেরে গেল। খবর ছড়ালো গাঁয়ে গাঁয়ে।
কিন্তু নিতাই পালের দল বসে নেই। একদিন রাতের অন্ধকারে অনিলার ক্লিনিকে আগুন দেওয়ার চেষ্টা হলো। গ্রামের যুবক সঞ্জয় আগুন নেভালো। সে বললো, “দিদি, তুমি ঠিক বলেছ। আমার বোনকে ওঝারা মেরেছিল গত বছর।”
চন্দ্রগ্রহণের রাত
গ্রামবাসীর সবচেয়ে বড় ভয়—চন্দ্রগ্রহণ। গর্ভবতী নারীদের বাড়িতে আটকে রাখা হতো, “গ্রহণের ছায়া শিশুকে বিকলাঙ্গ করে!” অনিলা নিজেই তখন গর্ভবতী। গ্রহণের দিনে সে ইচ্ছাকৃতভাবে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। গ্রামের মেয়েরা দেখে হতভম্ব! “তোর বাচ্চার কি হবে?” অনিলা হেসে বললো, “চাঁদ-সূর্যি কোটি কিলোমিটার দূরে। তাদের আলোতে শিশুর কি ক্ষতি হবে?” সে বিজ্ঞানের বই থেকে ব্যাখ্যা দিলো। কৌতূহলী মহিলারা জড়ো হলো। নয় মাস পর অনিলার কোল জুড়ে এলো সুস্থ শিশু—একটি মেয়ে। গ্রামের লোকেরা নাম রাখলো “জ্যোতি”।
ভাঙনের শুরু
মাসখানেক পর ঘটলো অভাবনীয়। গ্রামের প্রধান ওঝা নিতাই পালের নাতনী জ্বরে পড়লো। নিতাই গোমূত্র-তুলসীপাতা দিলেন, কিন্তু জ্বর বাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত লজ্জা ভেঙে সে অনিলার ক্লিনিকে এলো।
অনিলা কোনো কথা না বলে ইনজেকশন দিলো। মেয়েটি সুস্থ হলে নিতাই পাল বললো, “এতদিন ভুল করছিলাম।”
সেই দিন থেকে নিমতলায় শুরু হলো বিপ্লব। ওঝারা নিজেরাই আনলো পরিবর্তন:
– গোবর-গোমূত্রের বদলে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া শেখালো
– ঝাড়ফুঁকের স্থলে প্যারাসিটামল দিলো
– গর্ভবতী মায়েদের রক্তপরীক্ষার ব্যবস্থা করলো
আজ নিমতলা গ্রামে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র হয়েছে। অনিলা সেখানে প্রধান নার্স। গ্রামের মেয়েরা এখন ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক।