• শনিবার, ২৪ মে ২০২৫, ০১:০২ পূর্বাহ্ন

ছোটগল্প: পরাজয়

Reporter Name / ৬৯ Time View
Update : শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫

বাবুল হোসেন বাবলু

ঈদ এলেই প্রশ্নটা কুরে খায় রহিমকে। ঈদ অশান্তির না প্রশান্তির? ঈদ কি তার মত গরিবের জন্য?
দিনভর রিক্সা চালিয়ে সংসারের নূন্যতম চাহিদাই মিটে না তার উপন মহাজনের জমা! কোন কোন দিন মহাজনের জমা’ই হয় না -উপোষ করে দিন কাটাতে হয় বাচ্চাদের নিয়ে। তিন মেয়ে আর বউ নিয়ে পাঁচ জনের সংসার রহিমের। একটা ছেলের আশায় পর পর তিনটি মেয়ে। সারা বছর এক কাপড়ে কাটে বলা যায়। কতদিন ওদেরকে নতুন জামা কাপড় দিতে পারেনি -ভাবতেই চোখে জল আসে। বিয়ের পর হতেই বউ মরিয়ম ছেঁড়া শাড়ি জোড়াতালি দিয়ে পরে। ঈদে সবার বাচ্চা কাচ্চারা নতুন জামা পরে যখন ঈদে যায় রহিমের বুক ফেটে কান্না আসে। রাগ অভিমান করে গত তার ছোট ছোট বাচ্চারা ঈদের মাঠেই যায়নি। আবার সামনে ঈদ!
ভাবতে পারে না রহিম। হতভাগী বউ জানে সংসারের হাল। কখনো আবদার করে স্বামীকে বিব্রত করে না।
প্রতিবারই বাচ্চাদের আবদার –
‘ বাপজান এবার নতুন কাপড় দিতে হবে ‘
নিরুত্তর রহিম।দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে কিছুই করতে পারবে না রহিম।বারবার মিথ্যে আশ্বাস দিতেও মনে সায় দেয় না।
রোজ সকালে বেরিয়ে যায় রিক্সা নিয়ে। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও বাড়তি আয়ের উপায় নেই। বৃষ্টির দিন গুলোতে আরো দুরাবস্থা।মহাজনের ঘরে বাকি পড়ে যায়। মরিয়ম বলে –
‘ রিক্সা বাদ দিয়ে অন্য কিছু দেখেো না কেন? ‘
গরিবের ঘরে জন্ম রহিমের। বাপও সারাজীবন রিক্সা চালিয়েছে। কখনোই সুখের মুখ দেখেনি রহিম।মূলধনের অভাবে ব্যবসাপাতির চিন্তাও মাথায় আসেনি। তার অন্য ভাইয়েরা রোজ হাজিরায় মানুষের জমিতে কামলা দিয়ে সংসার চালায়।সেও গ্রামে রিক্সা চালাতো। বিয়ের পর পরিচিত দু’একজনের পরামর্শে ঢাকায় চলে আসে মরিয়মকে নিয়ে। মহাজনের কাছে বন্ধুর মত একজন সুপারিশ করে ওকে রিক্সা নিয়ে দেয়। নতুন সংসার হাসি খুশিতেই কাটছিলো। মহাজনের জমা দিয়ে সংসার ভালোই চলতো। তারপর একে একে এলো তিন সন্তান।বাড়তে থাকে খরছ।অভাব যেন ধীরে ধীরে নিত্যসঙ্গী হয়ে গেলো। বস্তির একটা ছাঁটাইয়ের চালা দেয়া ঘরে বসতি। বর্ষা এলে পানিতে বসবাস যেন।
এখানেও বস্তির মালিককে ভাড়া দিতে হয়।মাঝে মাঝে ভাবে গ্রামেই ফিরে যাবে। সেও হয় না। গ্রামের লোক ভাবে রহিম শহরে ভালো আছে।একবার শহরে এলে আর ফেরা হয় না। এ যে অঘোষিত জেলখানা।দিনকে দিন চেনা শহর অচেনা শহরে পরিণত। হররোজ হরতাল আন্দোলনে রাস্তা বন্ধ।বড় বড় অট্টালিকার পাশে বড়বেশি বেমানান রহিমরা।একপাশে অঢেল সম্পদের পাহাড় আরেকপাশে নিরন্নের হাহাকার।কিসের টানে শহরমুখী মানুষ? জবার জানে না রহিম।
তার ভাবনায় এখন শুধু দুদিন বাদে ঈদ।কি করে বাচ্চাদের মুখে হাসি ফোটানো যায়!
সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।শরীরও তেমন ভালো যাচ্ছে না।মরিয়ম গায়ে হাত দিয়ে বললো ‘জরিনার বাপ তোমার তো গায়ে জ্বর -আজকে যেতে হবে না ‘
মুচকি হেসে রহিম ছেঁড়া জমাটা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে। যদি বাড়তি কিছু আয় হয় -মেয়েদেরকে অন্তত ফুটপাত থেকে হলেও পরার মত জামা কাপড় নিতে হবে। এ দু’দিন মহাজনের জমা না হয় বাকি রাখবে বলে কয়ে।
বৃষ্টির দিনে ভাড়া কম। জরুরি কাজ ছাড়া কেউ বের হয় না।দুপুর অবধি এদিক সেদিক ঘুরে টুকটাক ভাড়া মারতে মারতে দুপুর। অন্যদিন হলে এসময় খাওয়ার জন্য বাসায় যেতো। আজকে বাসায় যাবে না রহিম।সন্ধ্যার পর একেবারে যাবে। বৃষ্টি ক্রমশ বাড়তে লাগলো। ভাগ্য অপ্রসন্ন রহিমের। যাত্রী ছাওনির নিচে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কাটলো। রাস্তায় যান চলাচল তেমন নেই। প্রাইভেট কার গুলো দ্রুত চলে যাচ্ছে। একজন মধ্য বয়েসী লোক এসে বললো ‘খালি যাবে?
অনেক দূরের রাস্তা। অন্য সময় হলে না বলতো। আজকে ওকে যেতে হবে। ভাড়াও সন্তোষজনক। যাত্রীটির সাথে বেশ কিছু ভারী মালামাল। চালাতে কষ্ট হচ্ছে রহিমের। প্যাডেলে যত চাপ দিচ্ছে -শরীর তত দুর্বল হচ্ছে। যাত্রীকে পৌঁছাতে হবে।অনেকটা পথ। প্রাণপণে প্যাডেলে পা চালিয়ে যাচ্ছে। গুলিস্তান থেকে রামপুরা। পা আর চলে না –
যাত্রী মহোদয় ক্ষেপে গেলেন’ জোরে চালাও -রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে -না খেয়ে রাস্তায় আসো নাকি?
জবাব দেয় না রহিম।সত্যিই তো সে না খেয়ে চালাচ্ছে। রামপুরায় যখন পোঁছায় রাত তখন দশটা পার।
শরীর ভিজে একাকার। কি করে বাসায় ফিরবে রহিম? শরীরে একটুও শক্তি নেই। ভাড়াটা নিয়ে একপাশে বসে কিছুক্ষণ জিরোয় রহিম।আবার ফিরতে হবে গুলিস্তান -তারপর বাসা আরো ভেতরে। বৃষ্টি ততোক্ষণে কিছুটা কমে এসেছে। একটা বন রুটি আর পানি খেয়ে রিক্সা চালানো শুরু করে রহিম।পথে দু’একজন যাত্রী পেয়েও নেওয়ার মত শক্তি অবশিষ্ট ছিলো না ওর। বাচ্চাদের কথা মনে পড়ছিলো বারবার। বৃষ্টিতেও ঘামছে শরীর -যেন চৈতের খরা। চলছে রিক্সা। রাস্তা যেন শেষ হয় না। রাস্তার বাতি গুলো আজ মলিন কেন? দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। রিক্সা যখন বস্তির কাছাকাছি আসে রাত তখন কত হবে মনে করতে পারে না রহিম।গেরেজ ততোক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। রিক্সাটায় তালা মেরে যখন বস্তির ঘরে পা রাখে তখনই এলিয়ে পড়ে দরজার সামনে। অচেতন রহিমের দেহটা বউ বাচ্চারা ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে যায়। জীবনের নির্মম পরাজয় টেনে আনে ঈদ নামের সোনালি স্বপ্ন। বাচ্চাদের কান্নার শব্দ বস্তির রাতের নীরবতা ভাঙে।

Facebook Comments Box


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
bdit.com.bd