• শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫, ১১:১৯ অপরাহ্ন

ছোটগল্প: চাকা ঘোরে জীবনের মতো

Reporter Name / ১২৫ Time View
Update : শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫

কলমে : মিফতাহুল জান্নাত তাসফি

ঢাকার উত্তপ্ত দুপুর। রোদের তাপে রাস্তার পিচ গলে গলে যেন জ্বলে উঠছে। তার মাঝেই একফাঁকে ছায়া খুঁজে রিকশা দাঁড় করিয়ে ঘাম মুছছিল হাশেম। বয়স পঁচিশের কোঠায়, তবে মুখের ক্লান্তি দেখে মনে হয় চল্লিশ ছুঁইছুঁই।

গ্রামের কাঁচা মাটির ঘর ছেড়ে শহরে এসেছে পাঁচ বছর হলো। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। দুই ভাইবোন আর মাকে নিয়ে চারজনের সংসার—গ্রামে। তাদের পেট চালাতে হাশেম রিকশা চালায়। রিকশা যেন তার বাহন নয়, জীবনের প্রতীক।

প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো। ঢাকার রাস্তা, মানুষের ভাষা, চাহিদা—সব ছিল অচেনা। তবু অভাব মানুষকে শিখিয়ে দেয় সব। সকালে বের হয়, সারাদিন রিকশা চালায়, রাতে দুইটা পরোটার সঙ্গে ডাল খেয়ে ঘুম। দিনের শেষে হয়তো চারশো-পাঁচশো টাকা রোজগার। তাতে বাড়ি টাকা পাঠানো, নিজের থাকা-খাওয়ার খরচ—সব সামলানো কঠিন।

একদিন রিকশা চালাতে চালাতে গুলিস্তানে এক যাত্রী উঠলেন। ঝকঝকে পোশাক, মুখে ক্লান্তির ছায়া। অফিস শেষে বাসার পথে। হাশেম ধীরে ধীরে রিকশা চালাচ্ছিল। হঠাৎ লোকটি জিজ্ঞেস করল,
— “এই কাজ কবে থেকে করো?”
— “পাঁচ বছর হইল ভাই।”
— “কষ্ট হয় না?”
— “হয়, কিন্তু কী করমু? মায়ের ঔষধ লাগে, বোনের স্কুলের খরচ, ভাইয়ের বই কিনতে হয়…”

লোকটা চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে বলল,
— “তোমার মধ্যে ইচ্ছা দেখছি। যদি ভালো কিছু করতে চাও, আমার বাসার গ্যারেজে কাজ লাগবে। ইচ্ছা থাকলে আসবা।”

সেই দিন ছিল হাশেমের জীবনের বাঁকবদলের শুরু।

কিন্তু তার আগে ও ছিল এক গল্প।
একদিন বৃষ্টিতে ভিজে রোগে পড়েছিল হাশেম। ঠান্ডা-জ্বর, শরীর ব্যথা। টানা তিনদিন রিকশা চালাতে পারেনি। খাওয়া নেই, ওষুধ কেনার টাকা নেই। সেই সময় একই গলির আরেক রিকশাওয়ালা মালেক তাকে ভাত এনে দিত, ওষুধ কিনে দিত নিজের টাকায়। হাশেম বুঝেছিল, গরীবের দুঃখ বোঝে গরীবই।

আরও একদিন, রাস্তায় হঠাৎ এক মেয়ের ব্যাগ ছিনতাই হয়। হাশেম দূর থেকে দেখে রিকশা নিয়ে ছিনতাইকারীকে ধাওয়া করে ধরেছিল। ব্যাগ ফিরিয়ে দিয়েছিল মেয়েটিকে। মেয়েটির নাম ছিল নিশি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। পরে প্রায়ই ওর রিকশায় উঠত, মাঝে মাঝে খাবার দিত।

হাশেম তখন ভেবেছিল—এই শহরের মানুষ সব খারাপ না। কারও না কারও চোখে তার জীবনের মূল্য আছে।

সেই লোকটার দেওয়া ঠিকানায় হাশেম একদিন গিয়েছিল। এক ধনী পরিবারের গ্যারেজ, সেখানে গাড়ি পরিষ্কার করা, যন্ত্রপাতি দেখা, ছোটখাটো ডেলিভারি—এসব কাজ। বেতন মাসে আট হাজার টাকা।

শুরু করেছিল নতুন জীবন। সকালে গ্যারেজ, বিকেলে রিকশা, রাতে চা দোকানে বসে হিসাব করা—কতটুকু এগোলো সে।

হাশেম আজও রিকশা চালায়, তবে আর আগের মতো নয়। এখন ওর নিজের একটা রিকশা আছে, লিজ নয়। মা শহরে এসেছে চিকিৎসার জন্য, বোন কলেজে পড়ে। ভাই এখন গ্রামে একটা কোচিং সেন্টার চালায়।

একদিন নিশিকে আবার রাস্তায় পায় হাশেম। সাদা পাঞ্জাবি পরা, পাশে এক ছোট্ট মেয়ে।
নিশি চিনে ফেলে হাশেমকে।
— “তুমি তো হাশেম, না? সেই যে ব্যাগ উদ্ধার করে দিয়েছিলে!”
হাশেম মাথা নিচু করে হাসে।
— “জ্বি আপা, আপনি খুব ভালো মনে রাখছেন।”

নিশি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন।
— “তোমার জীবন কত বদলে গেছে, তাই না?”
— “হ্যাঁ আপা, সময় ঘুরে… রিকশার চাকা যেমন ঘোরে… আর এই ঘোরে ঘুরে যায় একেকটা জীবনের গল্প।”

Facebook Comments Box


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
bdit.com.bd