ভিষণ কনকনে ঠান্ডা পড়ছে। চাঁদনী রা তিন ভাই বোন বাবার পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। কারো সাহস হচ্ছে না জিগ্যেস করার এবার কুরবানী দেয়া হবে কি-না।
চাঁদনীর বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ভিটেমাটি সব শেষ করে এখন একটি টিনের ঘরে বউ বাচ্চা নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। তাদের সুন্দর সংসার আর সুন্দর রইলো না। এসব বলে রুমি বেগম চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছেন।
তারপর কি হলো প্রশ্ন করলো সামনে সোফায় বসে থাকা রুমি বেগমের উকিল মা। তিনি দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন। ২০০৩ সালে আমার মেয়েটাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। সাথে তার ছোট ভাই ও যাওয়া আশা করতো। তখন ছোট ছেলেটা সাত মাসের পেটে। হঠাৎ একদিন ভোর রাতে ননস এসে আমার স্বামী কে বললেন ভাই রে আজ তুই দোকানে যাবিনা।
তোর পেছনে শত্রু পরে গেছে। কথাটি বলে তিনি রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেছেন। রমিজ মিয়া কথাটি আমলে নিলেন না।
কিন্তু সকাল আটটা বাজে দোকানে চিৎকার শুনা যাচ্ছে।
রুমি বেগম মনে কু ডাকছে। এমন সময় পাড়ার এক খালা এসে বললেন এইগো মা তোমার স্বামী কে মেরে রাস্তায় ফেলে রেখেছে।
দৌড়ে সবাই দোকানের পথে চললো। সত্যি তাই নিজের বড় বোন জামাই সম্পদ আর সমাজের কিছু নিয়ম নিয়ে কথা-কাটাকাটি হয় আগের দিন।
কিন্তু কে জানতো এ কথা নিয়েই তাকে আপন বোন জামাই এভাবে রক্তাক্ত জখম করে রাস্তায় ফেলে রাখবে। চাঁদনী ছোট কিন্তু নিজের বাবার এসব দৃশ্য তার অন্তরে কালো দাগ কেটে দিয়েছে।
অনেক দিন হাসপাতালে ভর্তি থেকে তারপর রমিজ মিয়া সুস্থ হলেন। কিন্তু ঘটনা হলো আরো দু বছর পর। মাথায় অতিরিক্ত আঘাতের ফলে তার ব্লাড ক্যান্সারে রুপ নিয়েছে ততদিনে।
প্রতি বছর কুরবানী দেয়া হয়, কিন্তু এ বছর তো রমিজ মিয়া নিজেই মরণপথের যাত্রী। কিভাবে তিনি কুরবানী দিবেন।
সবার মনোভাব তিনি বুঝতে পেরেছেন।
তিন সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি বলছেন চিন্তা করিছনা। আব্বু আর হয়তো বাঁচবো না।
তাই এটাই হবে আমার শেষ কুরবানী।
চাঁদনী রা কি বুঝছে কে জানে উঠোনে নেমে খুশিতে হই হুল্লোড় করেতেছে। রমিজ মিয়া জানালা দিয়ে সন্তানের আনন্দ দেখে চোখের পানি ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে রুমি বেগম কে বললেন।
দেখো আমার ছেলে মেয়ে কত খুশি। আমি মারা গেলে তুমি আমার সন্তান রেখে আর বিয়ে করোনা।
যদি করো আমার সন্তানের চোখের পানি কবরে আমাকে কষ্ট দিবে।
রুমি বেগম ও কাঁদছেন। তিন ভাই বোন ঘরে এসে হতবাক!
একি! কুরবানী দিলে কি কাঁদতে হয়? মনে মনে ভাবছে।
তাদের জানা ও নেই তাদের বাবা দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করতে চলেছেন। শুধু সন্তানের শেষ আনন্দ দেখার জন্য বর্গা দেয়া গরুটা নিয়ে এসে রাখলেন। পরের দিন ঈদের মাঠে নেয়া লাগবে যে।
রাতে চোখে ঘুম নেই রাত যেনো কাটছেই না তিন ভাই বোন এর।
তারা গল্প করছে কে কতটা রুটি খাবে গোস্তো দিয়ে। আর ঈদের মাঠে কি কি কিনবে এসব গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে গেলো তিনজন।
ঘুম নেই রমিজ মিয়ার চোখে সাথে রুমি বেগম ও চিন্তা করছেন। কি হবে তাদের ভবিষ্যতে। তিন সন্তান নিয়ে তিনি কোথায় যাবেন।
রাত পোহাতেই সবাই যে যার কাজে লেগে যায়। সকাল সকাল রুমি বেগম সেমাই রান্না করে সবাই কে দিলেন। সাথে রমিজ মিয়া ও একটু খেতে চেষ্টা করেন।
তিনি তো অনেক দিনই খেতে পারেন না। গলায় খাদ্য নালী বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি পেটের খিদায় কান্না করেন। আল্লাহ যে তার রিজিক অনেক আগেই নিয়ে গেছেন শুধু হায়াত বাকি আছে।
যার রিজিক নেই তিনি কোথায় পাবেন খাবার আল্লাহর হুকুম ছাড়া। তাই আজ কুরবানির গোস্তো রুটি পোলাও সব পেয়েও তিনি খেতে পারছেন না।
এ যে আমার রবের ইচ্ছে।
এসব বলতে বলতে রুমি বেগম অঝোরে কাঁদছেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তার উকিল মা। তিনি শান্তনা দিতে দিতে বললেন আল্লাহ তোর মঙ্গল করবে দেখিস মা। তুই সুখি হবি।
রুমি বেগম চোখের পানি মুছে আবারো বলতে লাগলেন।
সেবার আমাদের ঈদ ভালো হলেও তারপর আর কোন ঈদ পাইনি। তার আগেই তিনি মারা গেছেন ২০০৬ সালে আগস্ট মাসের ৬ তারিখে। তারপর আমার তিন ছেলে মেয়ে যেনো সব কিছুই বুঝে গেলো। কোন কিছুর জন্য বায়না করেনা। কিছু পেতে কান্না করে না। এতে আমার জন্য ভালো হলেও মনে মনে কষ্টে বুক ফেটে যায়।
উঠোনে খেলছে ছোট ছেলেটা মামাতো খালাতো ভাইবোনেরা মিলে। রুমি বেগম দু সন্তান বাড়িতে রেখে এসেছেন বাবার বাড়িতে। বাবার কাছ থেকে টাকা
ধান এসব নিয়ে যায়।
রুমি বেগম এর বাড়ি রামগর আর স্বামীর বাড়ি তাইন্দং। বিকেল হয়ে এলো তাই রুমি বেগম উকিল মায়ের বাড়ি থেকে নিজের বাবার বাড়িতে এলেন। এসে দেখলেন বাবা এখনো আসেনি বাড়িতে।
রাতে বাবার পাশে বসে বলছেন। বাবা আগামীকাল বাড়িতে যেতে চাই কতদিন হয়ে গেছে। আমার ছেলে মেয়ে কেমন আছে কি করছে কি খাচ্ছে আল্লাহ জানে।
আমি এবার যেতে চাই বাবা।
আলী আজ্জম কাজী নিজের মেয়েকে বারবার বলছেন তোর সন্তান তাদের গোষ্ঠীর কাছে দিয়ে তুই চলে আয়। এত অল্প বয়সে তুই একা হয়ে গেছিস। তোকে আবার বিয়ে দেবো চলে আয় তুই। বাবার কথা শুনে মনটা ধক করে ওঠলো।
একি অবস্থা বাবা! আমি আমার সন্তান রেখে আর বিয়ে করতে চাই না। তাদের কেউ কি আছে দেখার? আমি কালই বাড়িতে যেতে চাই। রুমি বেগম এর জেদের কাছে হার মানলেন কাজী সাহবে।
স্কুলের মাঠ পেরিয়ে কাজী বাড়ি। নামে ডাকে এক নাম। পাশাপাশি আর্মি কেম্প হওয়ায় সেখানে গ্রাম হলেও উন্নয়ন হচ্ছে দিনদিন। আম কাঁঠাল লিচু জাম্বুরা নারিকেল সব ফলের গাছগাছালি ঘেরা কাজী বাড়ি।
পরের দিন ঘুম থেকে ওঠেই রুমি বেগম গোছগাছ শুরু করেন। এসব দেখে মা মীরখাতুন কেঁদে বুক ভাসান। আমার মেয়েটা এ বয়সে সন্তান নিয়ে একা একা লড়ছে।
যেখানে পুরুষ মানুষ ও হাঁপিয়ে ওঠে।
মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন তিনি। আল্লাহ আমার মেয়ে টাকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দান করুন। আপনি সাহায্য করুন আমার আদরের মেয়ে টাকে।
এসব ভাবতে ভাবতে সি এনজি চলে এলো ঘর দুয়ারে। সবার নিকট বিদায় নিয়ে রুমি বেগম চললেন নিজের স্বামীর বাড়ি তাইন্দং। পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল তিনটা বেজে গিয়েছে।
রুমি বেগম এর ছোট ছেলে মেয়ে দুটো মাকে দেখে দৌড়ে এসে কাঁদতে থাকে।
আর বলতে থাকে মা আমরা আজ কতদিন ঠিক মতো খেতে পারিনা। ঘরে চাল নেই। দাদিও ভারত চলে গেছে ফুফুর বাসায়।