ধুলিমাখা প্ল্যাটফর্মের এক কোণে জবুথবু হয়ে বসে থাকে রহিম। কপালে গভীর রেখা, যেন কালের সাক্ষী। এই স্টেশনই তার ঘর, তার সংসার। জীবনের ঘানি টানতে টানতে শরীরটা ভেঙে পড়েছে, কিন্তু দু’চোখে এখনও স্বপ্ন – একটু ভালো থাকার, একটু শান্তিতে নিশ্বাস নেওয়ার।
বছর কুড়ি আগে এই স্টেশনেই কুলির কাজ শুরু করেছিল রহিম। তখন শরীর ছিল জোয়ান, মনে ছিল অফুরান আশা। একে একে ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, অভাবের সংসারেও হাসি লেগে থাকত। বড় মেয়ে রিনার বিয়ে দিয়েছে বছর খানেক আগে। ভেবেছিল, মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সুখে থাকবে। কিন্তু সুখ যেন তার কপালে নেই।
কয়েক মাস না যেতেই রিনার কান্নার রোল ভেসে আসে বাবার কানে। যৌতুকের জন্য তার উপর অকথ্য অত্যাচার করছে স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন। প্রতিবার মেয়ের কষ্টের কথা শুনে রহিমের বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। রিনার মলিন মুখ, ফোলা চোখের ছবি রাতের পর রাত তার ঘুম কেড়ে নেয়।
হতভাগ্য বাবা! মেয়ের কষ্ট লাঘব করার মতো সাধ্য তার নেই। বুকের ভেতর শুধু জমে থাকা ভালোবাসা আর দীর্ঘশ্বাস। রিনার স্বামী সাফ জানিয়ে দিয়েছে, মোটা অঙ্কের টাকা না পেলে সে রিনাকে ঘরে তুলবে না। আকাশ ভেঙে পড়লেও রহিম জানে, এত টাকা জোগাড় করা তার পক্ষে অসম্ভব।
মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তায় রহিম ধীরে ধীরে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। রাতের পর রাত ঘুম হয় না। খাওয়া দাওয়ায় অনীহা। শরীরটা যেন আর বইতে চায় না। একদিন রাতে, স্টেশনের এক বেঞ্চিতে বসে মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতেই তার নিথর দেহ এলিয়ে পড়ে।
সকালে অন্যান্য কুলি আর দোকানিরা এসে দেখে, রহিম আর নেই। তার পাশে পড়ে আছে একটা ছেঁড়া কাপড়ের পুঁটলি। ওটাই ছিল তার সারা জীবনের সঞ্চয় – মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য তিল তিল করে জমানো কিছু টাকা। কিন্তু হায়, সেই সামান্য ক’টা টাকাও রাতে কে বা কারা চুরি করে নিয়েছে।
রহিমের মৃত্যুর খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। স্টেশনের কর্মীরা, দোকানিরা, এমনকি কিছু যাত্রীও এসে ভিড় করে। সবার চোখে বিষাদের ছায়া। একজন গরিব, অসহায় মানুষের এমন মর্মান্তিক পরিণতি যেন সকলের মনে গভীর দাগ কেটে যায়।
কেউ কেউ ফিসফিস করে যৌতুকের অভিশাপের কথা বলে। সমাজের এই নির্মম প্রথার বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেয়। রিনার কথা ভেবে অনেকের চোখ ভিজে আসে। যে মেয়ে বাবার সামান্য সঞ্চয়টুকুর ভরসায় একটু আলোর স্বপ্ন দেখছিল, তার ভবিষ্যৎ এখন আরও অন্ধকার।
রহিমের মৃত্যু একটা নীরব প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়ায়। সেই স্টেশনের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে অসহায় এক বাবার দীর্ঘশ্বাসে, মেয়ের কান্নায় এবং সমাজের বিবেকহীনতার নীরব তিরস্কারে। প্রশ্ন জাগে – আর কত জীবন এভাবে যৌতুকের আগুনে পুড়বে? আর কত বাবা শুধু ভালোবাসার পুঁজি নিয়ে অসহায়ভাবে সন্তানের ভবিষ্যৎ আঁকড়ে ধরবে? সমাজের মানুষ কি কখনও মানবিকতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসবে না?
রহিমের জমানো টাকা চুরি হয়ে গেলেও, তার রেখে যাওয়া নীরব বার্তা হয়তো একদিন সমাজের ঘুম ভাঙাবে। হয়তো একদিন কোনও হৃদয়বান মানুষ রিনার পাশে এসে দাঁড়াবে, যৌতুকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস দেখাবে। সেদিন হয়তো রহিমের আত্মা শান্তি পাবে, আর কোনও বাবা মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রাতের অন্ধকারে একা মরবে না।
গল্প প্রকাশ করার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই,, আশা করি সবার ভালো লাগবে। ধন্যবাদ